নাটোরের পথে পথে রূপে রঙে অনন্য হাওয়াই মিঠাই

607

নাটোর, ১৯ আগস্ট, ২০১৮ (বাসস) : হাওয়াই মিঠাই ছাড়া শিশুকাল অতিক্রম করা সম্ভব নয়। এর তুলোর মত স্নিগ্ধ রূপ আর বাহারী রঙ খুব সহজেই কাছে টানে। শিশুদের তো বটেই বড়দেরও। এ চাহিদাকে উপলক্ষ্য করে নাটোরের পথে পথে বিপণন হচ্ছে সবার প্রিয় হাওয়াই মিঠাই।
শুধু নাটোরে নয়, সারাদেশে সমাদৃত হাওয়াই মিঠাই। শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বে জনপ্রিয় এ আদরণীয় হাওয়ার মিষ্টি। দেশে দেশে এর নামের ভিন্নতা। কেউ বলে কটন ক্যান্ডি, কেউবা ক্যান্ডি ফ্লস, কোন দেশে ফেয়ারী ফ্লস আবার কোথাও বা স্পুন সুগার। রূপ আর রঙের সাথে সাথে বাহারী নাম !
উইকিপিডিয়া সূত্রে জানা যায়, চৌদ্দ শতকে ইটালীতে চিনির ঘন রস থেকে প্রথম তৈরি হয়েছিল হাওয়াই মিঠাই। দেখতে অনেকটা সূতার মত। সম্ভবত আমাদের দেশের শন পাপড়ির মত অবয়ব। অনেকদিন পরে ১৮৯৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইলিয়াম মরিসন এবং জন সিয়ারটন হাওয়াই মিঠাই তৈরির মেশিন আবিষ্কার করেন। এরপর যেন ঘটে গেল এক বিপ্লব। ১৯০৪ সালে সেন্ট লুইস এর বিশ্ব মেলায় প্রথম দিনে মেশিনের তৈরি হাওয়াই মিঠাই বিক্রি হয়েছিল ৬৮ হাজার ৬৫৫টি। সেই থেকে সব দেশে সব কালে সমাদৃত হাওয়াই মিঠাই।
সারাবিশ্বে হাওয়াই মিঠাই এর সর্বাধিক উৎপাদক কানাডার টটসি রোল অব কানাডা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেফরন ফ্লেভারড কটন ক্যান্ডি সম্ভবত সবচে’ দামী। প্রাকৃতিক রঙ বা ফুড কালারে নানারঙে রঙিন আর স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি, ম্যাপল, লেভেন্ডার, আম কিংবা আপেল এর গন্ধে সুস্বাদু এক একটি কটন ক্যান্ডির দাম দুই হাজার টাকা। সব দেশ ছাড়িয়ে কটন ক্যান্ডির জন্যে অবারিত ভালবাসার নিদর্শন এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ৭ ডিসেম্বর তাদের “ন্যাশনাল কটন ক্যান্ডি ডে”!
এদেশে এখনো পুরোপুরি বাণিজ্যিক হয়ে উঠতে পারেনি হাওয়াই মিঠাই। আইসক্রিম, চকলেট, ক্যান্ডি বিপননের মত ফাস্ট ফুড কিংবা কনফেকশনারীগুলোতে বিক্রি হয়না এটি। হকারের মাধ্যমে চলে এর বিপণন। ক্ষতিকর রঙ পরিহার করে রকমারী খাবার রঙ ব্যবহার এবং নানান স্বাদের সুবাস ছড়িয়ে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠেনি এখনো।
শহরের নাটোর বোর্ডিং এ মেশিনে তৈরি হচ্ছে হাওয়াই মিঠাই। স্টিলের এ মেশিনের মাঝখানে দেওয়া হয় মূল কাঁচামাল চিনি। নীচে থাকা স্পিরিট ল্যাম্পের তাপে গলে যায় চিনি। আর হাতে মেশিন ঘোরালে স্টিলের বড় ডিশের চারপাশে মাকড়সার জালের মত ছড়িয়ে পড়ে হাওয়াই মিঠাই। পর্যায়ক্রমে জড়িয়ে নেয়া হয় বাঁশের কাঠিতে। সবশেষে ওয়াটার কালার পলিথিনে মুড়িয়ে ভেতরে বাতাস ঢোকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি। এভাবেই প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে শত শত হাওয়াই মিঠাই।
নাটোরে হাওয়াই মিঠাই তৈরির উদ্যোক্তা নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার আলমগীর হোসেন। সাথে একজন সহযোগী নিয়ে সারাদিনে চার-পাঁচ ঘন্টা মেশিন চালিয়ে তৈরি করেন সাদা আর গোলাপী রঙের অন্তত চারশ’ ষ্টিক হাওয়াই মিঠাই। এক কেজি চিনিতে তৈরি হয় ৫০ ষ্টিক হাওয়াই মিঠাই। গোলাপী রঙের জন্যে দশ কেজি চিনিতে এক গ্রাম পরিমাণ রঙ মিশিয়ে নিলেই হাওয়াই মিঠাই হয় গোলাপী রঙের। তবে এ রঙ স্বাস্থ্যসম্মত নয় এবং এ ব্যাপারে অবগতও নন আলমগীর। বিগত পাঁচ বছর ধরে এভাবেই তৈরি হাওয়াই মিঠাই নাটোর ও সিরাজগঞ্জে বিপণন করে আসছেন। আর তারও আগে পাঁচ বছর ধরে এভাবেই কাজ শিখেছেন বলে জানালেন তিনি।
স্বাস্থ্যসম্মত রঙ ব্যবহার এবং রকমারী গন্ধের হাওয়াই মিঠাই তৈরির প্রশিক্ষণ প্রদানে এগিয়ে আসতে পারে বিসিক এর মত উদ্যোক্তা সৃষ্টির প্রতিষ্ঠান। এব্যাপারে প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণের ব্যবন্থা নেয়া হলে হাওয়াই মিঠাই হবে আরো মজাদার ও আকর্ষনীয় বলে মত প্রকাশ করেছেন নাটোর শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি মোঃ আমিনুল ইসলাম।
আলমগীরের তৈরি করা হাওয়াই মিঠাই লম্বা দন্ডে সাঁজিয়ে প্রতিদিন বিপণনে বের হয় পাঁচ কিশোর। প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত পড়াশুনা করা ওদের সকলের বাড়িও নেত্রকোনা। হাওয়াই মিঠাই বিক্রেতা মোস্তফা জানায়, স্কুল, মার্কেটসহ জনসমাগমের স্থানগুলোতে বিক্রি বেশী। ঈদ বাজার, মেলাতেও ভালো বিক্রি। তবে রাস্তায় চলতে চলতেও বিক্রি হয়। শহরের কেজি স্কুল মনীষা ভবনের সামনে প্রথম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সিদরাতুল মুনতাহা চার ষ্টিক সাদা হাওয়াই মিঠাই কেনা সম্পর্কে বলে, বাড়িতে গিয়ে বড় আপুকে সাথে নিয়ে মজা করে খাব। সিদরাতুল মুনতাহার মা কলেজ শিক্ষক মাসুমা সুলতানা বলেন, গোলাপীটাতে ক্ষতিকর রঙ আছে, তাই সবসময় সাদাটাই কিনি।
বিসিক, নাটোর এর ব্যবস্থাপক দিলরুবা দিপ্তি বলেন, হাওয়াই মিঠাইতে খাবার রঙ ব্যবহার এবং এর মান উন্নয়নে প্রয়োজনে বিসিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে।
নাটোরের জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুন বলেন, হাওয়াই মিঠাই দেখলেই ছোটবেলার দিনে ফিরে যাই। অনেক আকর্ষনীয় ছিল ঐসব দিনে বাবা-মায়ের কাছে বায়না ধরে হাওয়াই মিঠাই খাওয়ার দিনগুলো। এ কুটির শিল্পকে টিকিয়ে রাখা, শিশু স্বাস্থ্য রক্ষা এবং এ উৎপাদনকে আরো আকর্ষনীয় ও বৈচিত্রময় করতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে বলা হবে।