হবিগঞ্জের বড়য়ান বিলে যুগ-যুগ ধরে চলে আসছে পলো বাইচ উৎসব

316

হবিগঞ্জ, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ (বাসস) : জেলার বানিয়াচং উপজেলার বিভিন্ন বিল ও হাওরে এখন চলছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী পলো বাইচ উৎসব। বিভিন্ন এলাকায় সপ্তাহে দুই দিন এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। পলো বাইচকে কেন্দ্র করে বড় মাছ ধরার জন্য প্রতিযোগিতাও হয় বিভিন্ন এলাকায়। বিভিন্ন এলাকায় এই পলো বাইচ বার্ষিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। এমনি এক উৎসব হয় বানিয়াচং উপজেলার আতুকুড়া গ্রামের বড়য়ান বিলে।
বড়য়ান বিলে গিয়ে গতকাল দেখা যায়, লোকজন ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে পলো দিয়ে মাছ শিকার করছেন। আবার কেউ কেউ ফাড় জাল ও ছিটকি জাল দিয়েও মাছ শিকার করছেন। শিকারীদের পলোতে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ উঠলেই শুরু হয় হৈ হুল্লুড়। বড় বড় বোয়াল, শোল, গজার, আইড়সহ বিভিন্ন মাছ ধরা পড়ছে শিকারীদের হাতে।
আতুকুড়া গ্রামের মাহির মিয়া নামে এক যুবক পলো বাইচে সবছেয়ে বড় মাছ ধরে সবাইকে তাক লাগান। ১০ কেজি ওজনের একটি গজার মাছসহ ৩টি মাছ শিকার করেন তিনি। এ ব্যাপারে তিনি প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, আমি প্রতি বছরই এখানে পলো নিয়ে মাছ শিকার করতে আসি। তবে এবছরই সবচেয়ে বড় মাছ শিকার করতে পেরেছি।
একই গ্রামের সালাউদ্দিন একজন প্রতিবন্ধি। তার এক হাত নেই। এক হাত দিয়েই সে পলো নিয়ে নেমে যায় বিলে। নিরাশ হতে হয়নি সালাউদ্দিনকে। সে তিনটি মাছ শিকার করে হাসিমুখে বাড়িতে ফিরে।
আতুকুড়া গ্রামের সাংবাদিক সুরুজ আলীর ৭ বছরের সন্তান সাইফ আলী আবীরও তার বাবার সাথে বিলে নেমে মাছ শিকার করেন। কোন মাছ না পেলেও সে এই উৎসবে অংশ নিতে পেরে আনন্দিত। তার পিতা হাত দিয়ে কেজি ওজনের একটি বাইম মাছ শিকার করেন।
শুধু আতুকুড়া গ্রামই নয়, জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে পলো নিয়ে শিকারীরা আসেন এই বিলে। উৎসবের পূর্বদিন থেকেই শিকারীরা আসতে থাকেন এখানে। লাখাই উপজেলার করাব গ্রামের এসএসসি পরীক্ষার্থী নজরুল ইসলাম জীবনের প্রথম আসে পলো বাইচে। প্রথম এসেই সে বাজিমাত করে বড় একটি গজার মাছ শিকার করে।
আতুকুড়া গ্রামের ইউপি সদস্য জালাল মিয়া জানান, গ্রামের বড়য়ান বিলে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে পলো বাইচ উৎসব। এক সময় জেলার নবীগঞ্জ, বাহুবল, আজমিরীগঞ্জ, লাখাই ও বানিয়াচং উপজেলায় এ প্রতিযোগিতার প্রচলন ছিল। বিভিন্ন নদী, বিলে এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতো। শুধুই মাছ ধরা নয়, এর মাঝে ছিল গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের মিশ্রণ। ছিল মানুষের বিনোদনেরও অন্যতম মাধ্যম এটি। বর্তমানে এটি হারিয়ে গেলেও আতুকুড়া গ্রামবাসী এ ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। পলো বাইচ উৎসবে অংশ নেয় বিভিন্ন স্থান থেকে সহ¯্রাধিক মানুষ। দু’দিন থেকেই আতুকুড়াসহ আশপাশের গ্রাম ও জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন মাছ ধরতে পলো নিয়ে বিলে হাজির হন। সাথে ছিল ভেড় জাল ও ছিটকি জালের সমারোহ। প্রতি বছর শীত মওসুমে হাওরের পানি কমতে শুরু করলে বানিয়াচং উপজেলার আতুকুড়া, সুবিদপুর, কাটখাল, মিঠাপুর, দরওয়া, মেওতুল, নাগুরা, সুনারুসহ আশপাশের গ্রামের মুরুব্বীরা বসে পলো দিয়ে মাছ শিকারের তারিখ নির্ধারণ করেন। নির্ধারিত দিনে কয়েক হাজার লোক পলো, জাল, দঁড়িসহ মাছ শিকারের বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে দলবদ্ধ হয়ে বিলে হাজির হন। মাছ শিকার উৎসব উপলক্ষে আশপাশের গ্রামগুলোতে বিরাজ করে উৎসবমূখর পরিবেশ। তিনি আরও জানান, এই বিলে আবারও পলো বাইচ উৎসব অনুষ্ঠিত হবে।
আতুকুড়া-সুবিদপুর শিক্ষা কল্যাণ সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হোসেন উজ্জল জানান, হাওরের বিল ও জলমহাল সরকার ইজারা দিলে ইজারাদাররা বিষ দিয়ে মাছ শিকার করেন। ফলে আগের মত পলো বাইচের সুযোগ কমে গেছে। অথচ পলো দিয়ে পানিতে একের পর এক ঝাপ দেওয়া আর হৈ হুল্লোড় করে সামনের দিকে ছন্দের তালে তালে এগিয়ে যাওয়া চিরচেনা গ্রামবাংলার অপরূপ সৌন্দর্যময় এক দৃশ্য হল পলো বাইচ উৎসব। বিভিন্ন স্থানে প্রতিযোগিতাও হত। বড় মাছ ধরার আনন্দের পাশাপাশি পুরস্কার নিয়ে বাড়িতে যেতেন শিকারীরা।