শীতকালিন সবজি হিসেবে ব্রুকলি চাষের প্রতি কৃষকদের আগ্রহ বেড়েছে

513

॥ শাহ ফখরুজ্জামান ॥
হবিগঞ্জ, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ (বাসস) : শীতকালিন সবজি আবাদে লাভজনক হওয়ায় এখন ব্রুকলি চাষে আগ্রহ বেড়েছে কৃষকদের। পাশাপাশি সৌখিনরাও এখন ঝুঁকছেন এই ফসলের দিকে। অনেকেই ছাদ বাগান ও টবেও আবাদ করছেন এই ফসল।
হবিগঞ্জে এ বছর ব্রুকলি সবজি চাষে সবাইকে তাক লাগিয়েছেন সফল কৃষক আব্দুল ছালাম। তিনি বাহুবল উপজেলার হাফিজপুর গ্রামের আব্দুল গফুরের ছেলে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ও ফলন ভালো হওয়ার কারণে চলতি মৌসুমে নিজের প্রায় ২০ শতক জমিতে ব্রুকলি চাষ করে ব্যাপক সফলতা পান তিনি। আব্দুল ছালামের সফলতা দেখে অনেকেই আগ্রহী হয়েছেন ব্রুকলি চাষে।
কৃষক আব্দুস ছালাম বলেন, ২০ শতক জমিতে ব্রুকলির চাষে তার ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। চাষাবাদে কোন প্রকারের কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়নি। পোকা দমনে ব্যবহার করেছি ফেরোমন ফাঁদ। চমৎকার কাজ করেছে। আর ভালো ফলনের জন্য শুকনো গোবর ও কিছু পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হয়েছে। বাম্পার ফলন হওয়ায় প্রায় ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকার ব্রুকলি বিক্রি করেছেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ফুলকপির মতো দেখতে গাঢ় সবুজ রংয়ের শীতকালীন এই ফসলটি হবিগঞ্জে পাওয়া যাচ্ছিল না। এখন এটি পরিচিত সবজি। এই সবজি আবাদ অনেক লাভজনক। ফসল বিক্রির জন্য বাজারে যেতে হয়না। আগ্রহীরা জমিতে এসেই কিনে নিয়ে যায়।
চুনারুঘাট উপজেলার গোপালপুরের বাসিন্দা উপ-সহকারী কৃষি অফিসার ফারুক আহমেদ বলেন, কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের পর তিনি নিজ জমিতে কৃষি কাজে ব্যস্ত থাকেন। তার সবজি চারার নার্সারীর পাশাপাশি সবজির ক্ষেতও আছে। তার সবজির নার্সারী থেকে কৃষক আব্দুল ছালাম ব্রুকলির চারা ক্রয় করে নিজ জমিতে রোপণ করে বাম্পার ফলন পেয়েছেন জেনে ভালো লেগেছে।
তিনি আরও জানান, আব্দুস ছালাম ছাড়াও তার কাছ থেকে চারা ও পরামর্শ নিয়ে ব্রুকলি চাষ করেছেন বিভিন্ন এলাকার কৃষক। তারাও লাভবান হচ্ছেন।
কৃষক তৌহিদ মিয়া বলেন, ব্রুকলি এখন ক্রেতাদের কাছে খুবই প্রিয়। ক্রেতারা আগ্রহ নিয়ে সবজিটি কিনছেন। দিন দিন ব্রুকলির চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী মৌসুমে আমার জমিতেও ব্রুকলি চাষ করতে প্রস্তুতি নিয়েছি।
উপজেলার দ্বিমুড়া কৃষি ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা শামীমুল হক শামীম বলেন, ইচ্ছে ও শ্রম থাকায় ব্রুকলি চাষে সফলতা পেয়েছেন কৃষক আব্দুল ছালাম। বাণিজ্যিকভাবে সবজিটি বাহুবলে প্রথম চাষ হয়েছে। সফলতা পাওয়ায় কৃষকরা উৎসাহিত হয়েছেন। আগামী মৌসুমে অনেক কৃষকই ব্রুকলি চাষ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সাধ্যমত কৃষকদের পরামর্শ প্রদান করছি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আবদুল আউয়াল জানান, আব্দুল ছালামের সফলতা দেখে উৎসাহিত হয়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ব্রুকলি চাষাবাদ শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে কৃষকরা। ব্রুকলি কেনার সময় সতেজ, শক্ত কুঁড়ি ও গাঢ় সবুজ দেখে কিনতে হবে। ব্রুকলির কুঁড়ি অংশটি খাওয়া যায়। আবার চাইলে নরম ডাঁটা অংশটুকু রাখতে পারেন। ডাঁটাতেও পুষ্টি আছে। রান্নার পাশাপাশি সালাদ ও মাংসের সঙ্গে রোস্ট করেও ব্রুকলি খাওয়া যায়।
হবিগঞ্জ শহরের বিয়াম ল্যাবরেরি স্কুলের ক্যাম্পাসের কিছু ফাঁকা জায়গায় ব্রুকলির চারা লাগান অধ্যক্ষ সৈয়দ রওশন সুলতানা। গাছগুলো যখন বড় হতে থাকে তখন সেখানে কাজ শুরু হয় নতুন ভবন নির্মাণের। তিনি গাছগুলো নষ্ট না করে সিমেন্টের বস্তায় মাটি দিয়ে সেগুলো স্থানান্তর করেন। পরে সেখানে বড় বড় ব্রুকলির ফলন হয়। প্রায় শতাধিক ব্রুকলির ফসল হয় সেখানে।
হবিগঞ্জ সরকারি বৃন্দাবন কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড, সুভাষ চন্দ্র দেব তার বাসার বেশ কয়েকটি টবে ব্রুকলি আবাদ করে সফল হয়েছেন। টবেতে ব্রুকলি গাছ নান্দনিক সৌন্দর্য্য সৃষ্টির পাশাপাশি তিনি খাওয়ার জন্য এগুলো ব্যবহার করেছেন। তিনি জানান, ব্রুকলি সরিষা গোত্রের উদ্ভিদ। আমাদের দেশে এখনো সেভাবে প্রচলিত হয়নি। তবে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হওয়ায় কৃষকদের আগ্রহ জন্মেছে। আমাদের দেশে সবুজ ফুলকপি নামে পরিচিতি পেলেও এটি মূলত ইতালিয়ান সবজি এবং ইউরোপ আমেরিকায় জনপ্রিয়। ব্রুকলি দোঁআশ মাটিতে ভালো জন্মে। লৌহ সমৃদ্ধ এবং ৫.৫-৬ পিএইচ মাত্রার মাটিতে ভালো ফলন পাওয়া যায়। আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চারা রোপনের উপযুক্ত সময়। রোপনের ৪-৫ সপ্তাহ পরই ফসল সংগ্রহের উপযুক্ত হয়। একেকটি ওজনে ১-৩ কেজি বা বেশি হতে পারে। ব্রুকলির পুষ্পমঞ্জরি খাদ্য হিসেবে ব্যবহার হয়।এছাড়া এর পাতা, ডগাও সবজি হিসেবে উপযুক্ত। পুষ্পমঞ্জরিতে অসংখ্য পুষ্প থাকে, এগুলো প্রস্পুটিত হওয়ার আগে কমপ্যাক্ট অবস্থায় ভালো দাম পাওয়া যায়। ব্রুকলির বেশ কয়েকটি প্রজাতি থাকলেও আমাদের দেশে সবুজ ব্রুকলির চাষ জনপ্রিয় হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, ব্রুকলিতে এন্টি অক্সিডেন্ট, ভিটামিন এ, সি, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফোলেট এবং পর্যাপ্ত আঁশ আছে। এটি কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে এবং উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। এছাড়া আইসোথিয়োসায়ানেট নামক পদার্থের উপস্থিতির কারণে এই সবজিটি ক্যান্সার প্রতিরোধী। আমাদের দেশে ধীরে-ধীরে এটি জনপ্রিয় হচ্ছে। কৃষকেরা ব্রুকলি সংগ্রহের সময় পুরো গাছটি তোলে বাজারজাত করেন। তবে এটি না করে কেবলমাত্র পুষ্পমঞ্জরিটি গোড়া থেকে কেটে সংগ্রহ করলে কেটে নেয়া স্থানের নিচের থেকে দ্রুত নতুন একাধিক পুষ্পমঞ্জুরি বের হয়। এভাবে একই মৌসুমে অধিক ফলন লাভ সম্ভব।
হবিগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক তমিজ উদ্দিন জানান, নিরাপদ ও বিষমুক্ত সব্জি আবাদ কর্মসূচির আওতায় হবিগঞ্জ জেলার কৃষকদেরকে উদ্বুদ্ধ করলে এবার ব্যাপকভাবে ব্রুকলি আবাদ হয়েছে। জেলার বাহুবল ও চুনারুঘাট উপজেলায় ব্রুকলি আবাদ হয়েছে বেশী। অনেক ফসল ইতোমধ্যে বাজারে এসেছে। আগামী ২ সপ্তাহ পর্যন্ত কৃষকরা ব্রুকলি আহরণ করবেন। আগামীতে সবজিটির আবাদ আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।