বাসস দেশ-২৬ : কোভিড-১৯ টিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে : অভিমত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের

96

বাসস দেশ-২৬
কোভিড-ভ্যাকসিন-সচেতনতা
কোভিড-১৯ টিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে : অভিমত সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের
।। মাহফুজা জেসমিন ।।
ঢাকা, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ (বাসস) : কোভিড-১৯ টিকা গ্রহণে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
বৈশ্বিক মহামারী কোভিড-১৯ মোকাবেলায় বিশ্বব্যাপী নানা গবেষণা ও প্রচেষ্টার ফলে মাত্র ১১ মাসের মাথায় বিশ্ববাসী মহামারী প্রতিরোধী টিকা হাতে পেয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই টিকা যত কম সময়েই তৈরি হয়ে থাকুক না কেন, এটি যথাযথ নিয়ম মেনেই তৈরি হয়েছে। তবুও টিকা নিয়ে বিশ্বব্যাপী মানুষের মনে রয়েছে সংশয়। আর এই সংশয় কাটাতে দেশে দেশে সরকার প্রধান, রাষ্ট্র প্রধান, প্রতিষ্ঠান প্রধান, স্বেচ্ছাসেবীরা টিকা নিয়ে অন্যদের উদ্বুদ্ধ করছেন।
ঢাকা শহরে কর্মরত চিকিৎসক, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, ব্যাংক কর্মকর্তা, লেখকসহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত সচেতন নাগরিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, টিকা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ আরো নিশ্চিত হতে চায়। তারা জানে না বলেই টিকা নেয়ার ব্যাপারে নানা সংশয় কাজ করে। তাদের মতে, গ্রামে গঞ্জে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি, মসজিদের ইমাম, স্থানীয় প্রশাসন, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা এই সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করতে পারেন।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা তখনই সুরক্ষিত থাকবো যখন জাতিগতভাবে দেশের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষ ভ্যাকসিন নেবে। ব্যক্তি আমার ভ্যাকসিন নেয়া মানেই, আমার পরিবার, চারপাশের মানুষ এবং দেশবাসীকে সুরক্ষা দেয়া। প্রত্যেকের ভ্যাকসিন নেয়া জাতিকে সুরক্ষা দেয়া কার্যক্রমের একটি অংশ। অতএব ব্যক্তির জায়গা থেকে যারা ভ্যাকসিন নিতে চাচ্ছেন না, তারা কিন্তু একই সাথে দেশবাসি, সমষ্টি এবং নিজের পরিবারের বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন।’
তিনি ভ্যাকসিন নেয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতে সমাজের বিভিন্ন পেশা যেমন- রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ অনুসরণীয় ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ডিএমসিএইইচ)-এর কোভিড-১৯ টিকাদান কেন্দ্রে টিকা পরবর্তী পর্যবেক্ষণে ছিলেন নিউ ইস্কাটন নিবাসী উম্মে হাবীবা (৬৩)। তিনি অনলাইনে নিবন্ধন করে টিকা নিতে এসেছেন। তিনি বলেন ‘আমার ভয় লাগেনি। আমিতো খুব খুশি এবং নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। কারণ, আমি এতো তাড়াতাড়ি কোভিড-১৯ এর টিকা নিতে পারলাম।’
বাসসে’র সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ এর মতো এতো ভয়াবহ ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে আমাদের সবাইকে অবশ্যই টিকা নিতে হবে।’
বকশিবাজারের দূর্গা রাণী দে (৫৬) স্বামীর সঙ্গে এসেছেন টিকা নিতে। তিনিও টিকা নিয়ে পর্যবেক্ষণ বুথে অপেক্ষারত। পাশের বুথে তার স্বামীও টিকা নিয়ে পর্যবেক্ষণে আছেন বলে জানান।
ডিএমসিএইচ-এর টিকাদান কেন্দ্রে কথা হয় উপ-পরিচালক ডা. আলাউদ্দিন আল আজাদের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রতিদিনই টিকা গ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত এই টিকাদান কেন্দ্রের আটটি বুথে পুরুষ ও নারীদের পৃথকভাবে টিকা দেয়া হয়। তিনি জানান, শুরু থেকে এ পর্যন্ত এই টিকাদান কেন্দ্রে টিকা নেয়া কোন ব্যক্তি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা জানাননি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফার্মাকোলজি বিভাগের প্রভাষক ডা. জয়শ্রী দাস অনলাইনে নিবন্ধন করে টিকা নিতে এসেছেন। নিবন্ধনের প্রিন্ট এনেছেন, কিন্তু সম্মতিপত্র আনা হয়নি। সম্মতিপত্র প্রিন্ট আনতে পাঠিয়ে অপেক্ষায় আছেন।
জয়শ্রী দাস বলেন, ‘টিকার নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরো সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে। আমরা সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থাকা সত্বেও যখন ভুল করছি, তখন সাধারণ মানুষ এই সেবা নিতে গেলে নানা হয়রানির শিকার হবে। তাই, নিবন্ধনের বিষয়ে আরো সচেতনতা তৈরি করা জরুরী।’
আজিমপুর মাতৃসদন ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, ডা. ইশরাত জাহান জানান, সকালের দিকে লোকজন কম থাকে। এজন্য টিকা দেয়া শুরু করতে দেরি করা হয়। কারণ- একটি ভায়াল (ঠরধষ) এ পাঁচ (৫) মিলিগ্রাম ঔষধ থাকে। একটি ভায়াল থেকে দশমিক পাঁচ (.৫) মিলিগ্রাম করে দশজনকে টিকা দেয়া যায়। যদি প্রথম একজন আসার পরই টিকা খোলা হয়, তারপর কে কতক্ষণে আসবে বা যদি কেউ না আসে তাহলে টিকাগুলো নষ্ট হবে। এতো প্রয়োজনীয় এবং দামী টিকাতো নষ্ট হতে দেয়া যায় না। তাই ছয় থেকে সাতজন টিকা নেয়ার জন্য একত্র হলে আমরা ভায়াল খুলে টিকা দেয়া শুরু করি। তিনি জানান, শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত এই কেন্দ্রে টিকা দেয়া হবে।
ডা. ইশরাত বলেন, ‘টিকার ব্যাপারে সংশয় কাটাতে সচেতনতা বাড়াতে হবে। আমার সহকর্মীদের অনেকেই টিকা নেবেন। কিন্তু তারা অন্যান্যদের টিকা নেয়ার ফলাফল দেখে টিকা নিতে চান। তাই, অন্যদের উৎসাহিত করতে আমি শুরুতেই টিকা নিয়েছি।’
তিনি জানান, সাধারণ মানুষের কাছে অনলাইনে নিবন্ধনের সুযোগ কম। অনেক সময় ভুল হয়ে যায়। তাই, এখানে যারা সরাসরি আসেন তাদের স্পট নিবন্ধন করেও টিকা দেয়া হচ্ছে।
ডা. ইশরাত কোভিড-১৯ টিকা গ্রহণে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে জোরালো প্রচারণার জন্য গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেও টিকা বিষয়ক প্রচারণার অন্যতম কৌশল হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
সরকারি চাকুরিজীবী শিহাবুর রেজা চৌধুরী (৬০) বলেন, ‘যেকোনো ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতেই পারে। সেটা মেনে নিয়েই এসেছি। আমি মনে করি, দেশব্যাপি কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সবার টিকা নেয়া উচিত।’
নগর উন্নয়ন অধিদপ্তরের সিনিয়র জিওগ্রাফার (রিসার্স অফিসার) মো. জাহাঙ্গীর আলী (৫২) বলেন, ‘এই টিকা একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফল। তাই, এই টিকাকে খারাপ মনে করার কোনো কারণ নেই। বরং বিশ্বব্যাপী এই মহামারি প্রতিরোধের জন্যই সবার টিকা নেয়া উচিত।’
মাতৃসদন ও শিশু স্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের টিকাদান কেন্দ্রে আরো কথা হয়, এই প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক (শিশু রোগ) ডা. কোহিনুর আক্তার খানমের সঙ্গে। তিনি বলেন, কোভিড প্রোটেকশনের জন্য রিস্ক বেনিফিট চিন্তা করে সবারই টিকা নেয়া উচিত।
একই প্রতিষ্ঠানের ডা. নাসরিন বেগম (গাইনি এ্যান্ড অবস) বলেন, ‘টিকা নেয়ার পর খুব ভালো লাগছে। প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টির ফলে অনেক উন্নত দেশকে পিছে ফেলে আমরা আজ টিকা নিতে পারছি। তাই আমি মনে করি, কোভিড-১৯ থেকে বাঁচতে টিকা সবার নেয়া উচিত।’
টিকাদান কেন্দ্রগুলো সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, চিকিৎসক বা সরকারি চাকরিজীবীদের পরিবারের সদস্যরাই টিকা দিতে এসেছেন। এ থেকে বোঝা যায় যে, সাধারণ মানুষ যে এখন টিকা নিতে পারছেন, এই বার্তাটি তাদের কাছে সুস্পষ্ট নয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৭ জানুয়ারি ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে কোভিড-১৯ টিকাদান কর্মসূচি উদ্বোধন করেন। এদিন মোট ২৬ জনকে টিকা দেয়া হয়। এরপর ২৮ তারিখ ঢাকার চারটি কেন্দ্রে আরো প্রায় ৫০০ জনকে টিকা দেয়া হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় দেশব্যাপি জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি। এই কর্মসূচির আওতায় সারাদেশে ১০০৫টি কেন্দ্রে টিকা দেয়া শুরু হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সুত্রে জানা যায়, টিকা নেয়ার জন্য নিবন্ধনের সংখ্যা এখনো লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কিছু কম রয়েছে। বর্তমানে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারিসহ ৫৫ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তিদের টিকা গ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। তবে, চল্লিশোর্ধ ব্যক্তিরাও টিকার জন্য নিবন্ধন করতে পারবেন।
বাসস/বিপ্র/এমজে/১৭৫৫/আরজি