রাজধানীতে ব্যতিক্রমী হোটেল, যেখানে খাবার মেলে ভালো কাজের বিনিময়ে

607

।। আফরোজা আঁখি ।।
ঢাকা, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ (বাসস) : প্রতিদিন তিনশ’ থেকে সাড়ে তিনশ’ মানুষ রাতের খাবার খান এই হোটেলে। এখানে খাবার খেতে কোন টাকা লাগে না। অন্তত একটি ভালো কাজ করার বিনিময়ে পাওয়া যায় রাতের খাবার। রাজধানীর কমলাপুর বাসস্ট্যান্ডে চলছে এই ‘ভালো কাজের হোটেল’।
অভিনব এই হোটেলের প্রতিষ্ঠাতা আরিফুর রহমান জানান, স্কুল জীবনে হুমায়ন আহমেদের ‘সবুজ ছায়া’ নাটক ও সেই নাটকে জাহিদ হাসানের অভিনয় দেখে তিনি ভালো কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হন। প্রতিদিন তিনি ভালো কাজ করার চেষ্টা করতেন। পরবর্তীতে, ২০০৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় কয়েকজন বন্ধু মিলে চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছিলেন। হঠাৎ সেখানে একজন লোক হাসপাতালে ভর্তি তার ছেলের চিকিৎসার জন্য টাকা চাইতে আসেন। ছেলেটির অপারেশন করতে ২০ হাজার টাকা প্রয়োজন। তার মধ্যে ১৫ হাজার টাকা জোগাড় হয়েছে। এখন আরও ৫ হাজার টাকা দরকার। আরিফুর এবং তার বন্ধুরা মিলে এই টাকা জোগাড় করেন এবং লোকটির সঙ্গে হাসপাতালে গিয়ে তার ছেলের চিকিৎসায় সহায়তা করেন। ছেলেটি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন।
তখন পথ শিশুদের খাওয়ানোর বিষয়টি তার মাথায় আসে এবং তারা কয়েকজন বন্ধু মিলে খাবার রান্না করে কমলাপুর রাস্তার পাশে পথ শিশুদের খেতে দিতে শুরু করেন। প্রথমে তারা মাঝে মধ্যে খাবার পরিবেশন করতেন। পরবর্তীতে ২০১৯ সাল থেকে নিয়মিত খাবার পরিবেশন শুরু করেন।
প্রতিদিন বাসাবোতে অবস্থিত একটি স্কুলে রান্না করে এই খাবার কমলাপুরে নিয়ে আসেন তারা । শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন সন্ধ্যার পর তারা খাবার পরিবেশন করেন কমলাপুর বাসস্ট্যান্ডে। শুক্রবার তারা বিভিন্ন মসজিদ- মাদ্রাসায় খাবার পরিবেশন করেন। এর পাশাপাশি এয়ারপোর্ট, বনানী কবরস্থান, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও সদরঘাটে সপ্তাহে একদিন করে খাবার পরিবেশন করে এই সংগঠনটি।
কিছুদিন আগে চট্টগ্রামেও শুরু হয়েছে এই হোটেল। বর্তমানে সেখানে মাসে একদিন করে খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। হোটেলের পাশাপাশি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বাড্ডা আনন্দ নগর ও বাসাবোতে দু’টি স্কুলও রয়েছে তাদের। স্কুল দু’টিতে আড়াইশ’র বেশি সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা পড়ালেখা করছে।
বর্তমানে বাসাবোতে তাদের একটি অফিসও রয়েছে। এই কাজে তাদের সহায়তা করছে স্কুল-কলেজের অনেক শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে সিহানুর রহমান আসিফ ও জাকির হোসেন দু’জনেই গ্রাজুয়েশন শেষ করেছেন। একাজে আরও যাদের প্রতিদিন দেখা যায় তাদের মধ্যে-অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফারহান রহমান, প্রায় দেড় বছর ধরে এই হোটেলে কাজ করছেন। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দুস্থ-অসহায় মানুষের সেবায় নিয়োজিত ফারহান জানান, অনলাইনে ক্লাস করে টিউশনি সেরে তাড়াতাড়ি এখানে চলে আসেন। এখানে না এসে ফারহান থাকতে পারেন না। প্রতিদিন এই মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বলতে, তাদের খাওয়াতে তার অভ্যাস হয়ে গেছে। কাজটি খুব আনন্দের সঙ্গেই করেন ফারহান। দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী অনিক ছয়সাত মাস ধরে কাজ করছেন এই হোটেলে। তাদের সহযোগিতা করছেন। বি এ প্রথম বর্ষে পড়ছেন অনিক। মাঝে মধ্যে এসে খাবার পরিবেশন করেন তিনিও। এ সংগঠনটির ‘ডেইলি টেন মেম্বার’ও অনিক। অনেকেই পড়ালেখার পাশাপাশি এই হোটেল স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন দুস্থ-অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে।


মান্ডা থেকে ফিরোজ (৫০) প্রতিদিন হুইল চেয়ারে করে তার মা জাইদাকে (১০০) নিয়ে আসেন, ভালো কাজের হোটেলে খেতে। হুইল চেয়ারে প্রতিবন্ধী মালিকে (১৬) প্রতিদিন নিয়ে আসেন মা জরিনা বেগম। মালি কথা বলতে পারেন না। জরিনা বেগমের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি আজ কি ভালো কাজ করেছেন। জরিনা জানান, তিনি একটি মেয়েকে বস্ত্র দান করেছেন। মেয়েটি প্রায় বস্ত্রহীন ছিলেন।
স্বামীসহ ফুটপাতে থাকেন লাভলী। প্রতিদিন এখানে রাতের খাবার খান। দিনে ময়লা ফেলেন। রাস্তার আবর্জনা থেকে বোতলসহ অন্যান্য সরঞ্জাম সংগ্রহ করে বিক্রি করেন। কি ভালো কাজ করেছেন জিজ্ঞেস করলে লাভলি জানান, একজন বৃদ্ধাকে খাইয়েছেন (নিজে না খেয়ে)। খেতে আসা রুমা জানান, তিনি এক বৃদ্ধার বাজার রিকশায় তুলে দিয়েছেন।
সংগঠকদের একজন মনির জানান, এ ধরনের ছোটো ছোটো ভালো কাজ সবসময় করে থাকেন। বিশেষ করে স্টেশনে বসবাসরত এই মানুষগুলো। তারা একে অপরকে বিভিন্নভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেন। মনির ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছেন। এই হোটেলে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন। কমলাপুর হোটেলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি।
মনির সংগঠনের সদস্য হওয়ার নিয়ম জানিয়ে বলেন, সদস্যদের একটি মেটালের ছোট ব্যাংক দেয়া হয়। তার মধ্যে প্রতিদিন দশ টাকা করে জমা করে বা মাসে ৩শ’ টাকা করে সংগঠনকে দিতে হবে।
আরিফুর জানান, সংগঠনের জন্য প্রতিদিন দিন ১০ টাকা জমা করে মাসে ৩শ’ টাকা দেন এমন সদস্য সংখ্যা প্রায় ৭৮৫ জন। মাসে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা ফান্ড কালেকশন হয়। তবে, সব সদস্য নিয়মিত টাকা দেন না। ফলে, মাঝে মধ্যে টাকার অভাবে মিল বন্ধ রাখতে হয় বলেও জানান তিনি। আবার অনেকে জন্মদিন বা মিলাদ উপলক্ষে কোন কোন দিন এখানে খাবারের ব্যবস্থা করেন জানিয়ে আরিফ বলেন, এখানে সপ্তাহে শুক্রবার ও শনিবার ডিমসহ মুরগি খিচুরি দেয়া হয়। তাতে এই দু’দিন ১৫ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকা খরচ হয়। অন্যান্য দিন ডিম খিঁচুড়ি দেওয়া হয়। তাতে খরচ হয় সাড়ে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা।
আরিফুর বলেন, ফুটপাতে খাবার পরিবেশনে বৃষ্টির দিনে অসুবিধা হয়। তারা ভিজে ভিজেই খাওয়ান। অসহায় মানুষগুলোও বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই খান বলে জানান তিনি।
একটি পরিবর্তনের গল্প: প্রতিদিন ৪০-৫০ জন করে কয়েক ব্যাচে খাবার পরিবেশন করা হয় এই হোটেলে। কয়েক বছর আগে, লাস্ট ব্যাচে খেতে বসতেন ১২-১৬ বছর বয়সের ৪৫-৫০ জন কিশোরী। যারা পেশায় ছিলেন যৌনকর্মী। প্রতিদিন তাদের কাছেও জানতে চাওয়া হতো, তারা কি ভালো কাজ করেছেন? ভাল কাজের কথা বলতে বলতে তারাও ভাল কাজ করতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। আরিফুর রহমান জানান, এই মেয়েরা প্রতিদিন ভালো কাজের কথা ভাবতে ভাবতে ভাল কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয় এবং এদের অধিকাংশই তাদের পেশা ছেড়ে দেন। তারা অনেকেই এখন গার্মেন্টসে চাকরি করছেন।
তিনি বলেন, ‘এখন এদের সংখ্যা লক্ষ্যনীয় মাত্রায় কমেছে। তিনি আরও বলেন, এখানে তাদের পেশা নিয়ে কখনো কোন কথা জিজ্ঞেস করা হয় না। তবে, তারা কি ভালো কাজ করেছেন? তা জানতে চাওয়া হয়।’
একদিন একটি মেয়ে প্রতিষ্ঠাতা আরিফুর রহমানকে বলেন, ‘মামা, আমি প্রতিদিন ভালো কাজ করার চেষ্টা করি। কিন্তু পাই না। আজ একটা ভালো কাজ করেছি শুনেন’ত হয়েছে নাকি? বলতে শুরু করেন মেয়েটি- কমলাপুর রেলস্টেশনে একজন বয়স্ক মানুষ তার ভারি ব্যাগ টানতে কুলি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। আবার ব্যাগটা তিনি টানতেও পাচ্ছিলেন না। তখন আমার মনে হল আমি যদি ব্যাগটা টেনে দেই, তাহলে সেটা আমার আজকের ভালো কাজ হবে। আমি আপনাদের বলতে পারব। তখন আমি তার ব্যাগটা গাড়িতে তুলে দেই। লোকটি আমাকে ১শ’ টাকা দেন। কিন্তু আমিতো টাকা নিব না। টাকা নিলে তো ভালো কাজ হবে না। লোকটি আমাকে জোর করলে আমি তাকে ভাল কাজের কথা বলি। তখন লোকটি হেসে আমাকে টাকাটা দিয়ে বললেন, এটা দিয়ে তুমি দুপুরে ভাত খাবে এটাও একটা ভাল কাজ হবে। বলেন তো মামা এটা কি ভালো কাজ হলো?’
এই হোটেলের বিশেষ একটা প্রাপ্তির ঘটনা তুলে ধরে আরিফুর রহমান বলেন, ‘তাদের ডেইলি টেন মেম্বার’ হতে আসেন জাহিদ নামের এক ব্যক্তি। জাহিদ তাদেরকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে জানান, গত তিন মাস ধরে এই হোটেলে নিয়মিত খেতেন তিনি। জীবনের অর্থ হারিয়ে পথে পথে ঘুরছিলেন জাহিদ। এখানে প্রতিদিন ভাল কাজের কথা শুনতে শুনতে, ভাল কাজ করতে উদ্বুদ্ধ হন জাহিদ এবং তিনি এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন। উত্তরার একটি শোরুমে চাকরি নিয়েছেন। তাই, তিনি প্রথম দিনই ভাল কাজের হোটেলের মেম্বার হতে এসেছেন।
দৈনন্দিন কাজকর্ম শেষে ঘরে ফেরার পথে এমন একটা পরিবেশ সত্যি অকল্পনীয়। যেখানে শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ সারি বেঁধে বসে মনের আনন্দে খাবার খাচ্ছেন। তাদের মুখে নির্মল তৃপ্তির হাসি প্রতিদিনের পথ চলায় যেন এনে দেয় নির্মল প্রশান্তি।