বাসস দেশ-১ : নাটোরে মাজলি বুননে সমৃদ্ধির হাতছানি

110

বাসস দেশ-১
মাজলি বুনন
নাটোরে মাজলি বুননে সমৃদ্ধির হাতছানি
নাটোর, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ (বাসস) : বাগাতিপাড়া উপজেলার গালিমপুর। শান্তিময় ছোট্ট এ গ্রামটি পরিচিতি পেয়েছে মাজলি গ্রাম হিসেবে। উপজেলার পাশের গ্রামগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে এ হস্তশিল্প। গ্রামগুলোর প্রায় প্রতিটা বাড়ির নারী সদস্যরা মাজলি বুননে ব্যস্ত। আর্থিক টানাপোড়েনের সংসারগুলোতে শরীর পরিষ্কার করার মাজলি তৈরীর কার্যক্রমে স্বচ্ছলতা আসতে শুরু করেছে। এ জনপদ জুড়ে এখন সমৃদ্ধির হাতছানি।
উপজেলার গালিমপুর গ্রামের নীলা বেগম। স্বামীর উপার্জনের টাকায় সংসারের ব্যয় নির্বাহ করে ছয় সদস্যের পরিবারে মাধ্যমিকে দুই সন্তানের পড়ালেখার খরচ চালানো দায় হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এ মাজলি তৈরীর কাজ আশার আলো দেখিয়েছে নীলাকে । এখন মাজলি বুনে মাসে ছয় হাজার টাকা আয় করেন। এ উপার্জনেই অনায়াসে চলে দুই ছেলের পড়ালেখা।
মুরাদপুর গ্রামের গৃহবধূ সুইটি বেগম। বিয়ের পর থেকেই স্বামীর সীমিত আয়ে সংসারের অস্বচ্ছলতায় দিশেহারা ছিলেন সুইটি। এখন স্বচ্ছলতা ফিরতে শুরু করেছে তাঁর সংসারে। তিনি বাড়িতে বসেই কাজের ফাঁকে ও অবসরে নিজের হাতে মাজলি তৈরী করেন। হাতের এ কাজ তাকে দিয়েছে মাসে প্রায় ছয় হাজার টাকার আয়। স্বামী-সন্তান নিয়ে তিনি সংসারে এখন সুখেই দিন কাটাচ্ছেন। নিজের উপার্জনে কিনেছেন ফ্রিজ, খাটসহ অন্যান্য সংসারের উপকরণ।
উপজেলার গালিমপুর, নওশেরা, মাছিমপুর, মুরাদপুরসহ কয়েকটি গ্রাম সরজমিনে ঘুরে এ হস্তশিল্পটির ব্যাপক প্রসার লক্ষ্য করা যায়। গ্রামের বধূ, শিক্ষার্থী, তৃতীয় লিঙ্গের অনেকেই তাদের নিজ নিজ বাড়িতে বসেই নিজেদের কাজের অবসরে নিপুণ হাতে তৈরী করছেন এ মাজলি। কুরুশ-কাঁটায় রঙ-বেরঙের সূতোর কাজ। অবসরে-আড্ডায় চলছে শিল্প কর্ম।
এসব গ্রামে এ হস্তশিল্পের সাথে বসবাস রেশমি বেগম, চুমকি আক্তার আর পারুল বেগমসহ শত শত নারীর। তাঁরা জানান, কামরুল ইসলাম তাদের সূতাসহ মাজলি তৈরির সব উপকরণ যোগান দেন। তৈরী শেষে হলে আবার সেগুলো সংগ্রহ করে বাজারজাত করেন। প্রত্যেকটি তৈরি মাজলির আকার ভেদে নির্দিষ্ট মজুরি পাই আমরা। বড় আকারের প্রত্যেক মাজলির জন্য দশ টাকা, মাঝারির জন্য ছয় টাকা এবং ছোট আকারের মাজলি প্রতি মজুরি চার টাকা। মাসে একজন চারশ’ থেকে ছয়শ’ মাজলি তৈরী করতে পারেন। এতে মাসে আমাদের একেকজনের উপার্জন সাড়ে তিন হাজার টাকা থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত। এতে আমাদের নিজস্ব কোন খরচ নেই। তাই উপার্জনের পুরো অর্থই আমরা নিজেদের কাজে ব্যবহার করতে পারি।
২০১৪ সালের কথা। বাগাতিপাড়ার গালিমপুর পারকুঠী গ্রামের নাজিমুদ্দিনের ছেলে কামরুল ইসলাম লক্ষ্য করেন, শিশু শিক্ষার্থীদের মায়েরা স্কুলে তাদের ছেলে-মেয়েদের রেখে বাইরে বসে অলস সময় পার করেন। এসব নারীদের অলস সময়কে কাজে লাগাতেই হাতে তৈরী মাজলির ধারনা মাথায় আসে কামরুল ইসলামের। গালিমপুর থেকে শুরু হলেও মাত্র কয়েক বছরেই হস্তশিল্পটি ছড়িয়ে পড়ে উপজেলার কয়েকটি গ্রামে। এ অঞ্চলের শত শত নারী এখন মাজলি বুনন কাজে সম্পৃক্ত হয়ে নিয়মিত আয় করছেন।
উদ্যোক্তা কামরুল ইসলাম জানান, ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল নতুন কিছু করার। সেই স্বপ্ন আর আত্মবিশ্বাস থেকেই পথ চলা। নিজ উদ্যোগে আগ্রহী নারীদের মাজলি বুননের বিনা খরচে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি, সরবরাহ করি সূতা আর কুরুশ-কাঁটা আর বুননের পরে নিজেই সংগ্রহ করি মাজলিগুলো। এসব মাজলি নাটোর ছাড়াও ঢাকা, চট্রগাম, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও তার মাজলির বেশ কদর রয়েছে।
সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার ভবিষ্যত লক্ষ্যের কথা জানিয়ে কামরুল ইসলাম বলেন, সার্ভিস চার্জে অর্থায়নের সুবিধা পেলে ব্যবসায়ের পরিধি আরো বৃদ্ধি করতে পারবো।
বাগাতিপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রিয়াংকা দেবী পাল বলেন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ হস্তশিল্পটির সাথে জড়িত উদ্যোক্তা এবং কর্মে নিয়োজিত নারীদের চাহিদা বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করা হবে। একই আশ্বাস প্রদান করেছেন বাগাতিপাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অহিদুল ইসলাম গকুল।
বাসস/এনডি/সংবাদদাতা/১০৩০/নূসী