মেহেরপুরে হারিয়ে যাচ্ছে খেজুর রসের উৎসব

305

॥ দিলরুবা খাতুন ॥
মেহেরপুর, ২৭ জানুয়ারি, ২০২১ (বাসস) : এক দশক আগেও চোখে পড়তো বিকেল থেকে সন্ধ্যে অব্দি খেজুর গাছ কাটার সরঞ্জামসহ গাছির ব্যস্ততা। সাত সকালে খেজুরের রস নিয়ে গাছিদের ‘রস নেবেন রস, খেজুরের রস, জিড়িন কাঠের রস’ এর হাকডাক । সেই শীত থাকলেও তেমনটা আর চোখে পড়েনা। প্রধান কারণ বিভিন্ন কারণে খেজুর গাছ নিধন। এতে দিনে দিনে জেলায় কমছে খেজুরের গাছ। দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে খেজুরের রসও। সেই সাথে হারিয়ে যাচ্ছে খেজুর রসের উৎসব।
গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য খেজুর গাছ। এ খেজুরের রস নিয়ে সোমবার কাকডাকা ভোরে দেখা মেলে জেলা শহরের উপকন্ঠ গোভিপুর গ্রামের রফিকুল হোসেনকে। কুয়াশা আর শীত নিবারণ পোশাকে আচ্ছাদিত রফিকুল ডেকে ফিরছেন ‘রস নেবেন রস, খেজুরের জিড়িন কাঠের রস’। তার ডাক শুনে বিভিন্ন বাড়ি থেকে ছুটে আসছে বিভিন্ন বয়সের নারী পুরুষ। কাঁচের প্রতি গ্লাস রমের দাম ১০ টাকা। সেই হিসেবে মাটির একঠিলি রস বিক্রি করছেন ২শ টাকায়। কেউ বা ঠিলি ধরে কিনছেন খেজুর রসের ক্ষীর, পায়েস ও পিঠা খাওয়ার জন্য। রস বিক্রেতা রফিকুল জানান, খেজুরের গাছ কমে যাওয়ায় তাদের চাহিদাও কমে গেছে। আগে এ কাজ করে ভালোভাবেই সংসার চালাতেন। এমনকি আগে যে আয় রোজগার হতো তাতে সঞ্চয়ও থাকতো, যা দিয়ে বছরের আরো কয়েক মাস সংসারের খরচ চলতো। গ্রামে যে কয়েকটা খেজুর গাছ আছে তা বুড়ো হয়ে যাওয়ায় রস তেমন পাওয়া যায় না। তিনি জানান, এইতো কয়েক বছর আগে এক হাড়ি খেজুর রস বিক্রি করতেন ২০ টাকা। এখন খেজুর গাছ না থাকায় সে রসের দাম বেড়ে হয়েছে ২০০ টাকা।
দিনে দিনে মেহেরপুর অঞ্চলে খেজুর গাছ কমতে থাকলেও হারিয়ে যায়নি সুস্বাদ ও পিঠাপুলির জন্য আবশ্যক উপকরণ খেজুর রসের চাহিদা রয়েছে। তবে আগের মত খেজুরের রস ও গুড় পাওয়া যায় না। পেলেও আগের চেয়ে ১০ গুন বেশি দাম দিয়ে কিনতে হয়। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য এ খেজুরগাছ আজ অস্তিত্ব¡ সঙ্কটে। যে হারে খেজুরগাছ নিধন হচ্ছে সে তুলনায় রোপণ করা হয় না। শীত মৌসুমে সকালে খেজুরের তাজা রস যে কতটা তৃপ্তিকর তা বলে শেষ করা যাবে না। আর খেজুর রসের পিঠা এবং পায়েস তো খুবই মজাদার। এ কারণে শীত মৌসুমের গ্রামাঞ্চলে রসের ক্ষীর, পায়েস ও পিঠা খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। শুধু খেজুরের রসই নয়, এর থেকে তৈরি হয় গুড়। রস আর গুড় ছাড়া আমাদের শীতকালীন উৎসব ভাবাই যায় না।
মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, কাচা রসের পায়েস খাওয়ার কথা এখনো ভুলতে পারি না। আমাদের নাতি-নাতনীরা তো আর সেই দুধচিতই, পুলি-পায়েস খেতে চায় না। তবুও ছিটেফোঁটা তাদেরও কিছু দিতে হয়। তাই পিঠাপুলির আয়োজন করা হয়।
মেহেরপুরের ইতিহাস ঐতিহ্য বিষয়ক লেখক তোজাম্মেল আযম বলেন খেজুরগাছ পরিবেশ বান্ধব একটি বৃক্ষপ্রজাতি। গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে খেজুর গাছের। খেজুরের রস, গুড় দারিদ্র বিমোচনে বাঙ্গালি সাংস্কৃতিতে জায়গা করে রেখেছে প্রাচীনকাল থেকে। খেজুরগাছকে মধুবৃক্ষও বলা হয়। কুটির শিল্পে খেজুরের পাতার ব্যাপক ব্যবহার ও কদর রয়েছে। খেজুর পাতা দিয়ে তৈরী হয় হাতপাখা, ঝাড়–, থলে, ছিকা, নানা রকম খেলনা। খেজুর ফলের ভেষজগুণও রয়েছে। জ¦ালানি হিসেবেও খেজুর গাছের চাহিদা অনাদিকাল থেকে। এ অঞ্চলে গাছিদের একটি বুলি এখনও প্রবীণদের মুখে মুখে ফেরে ‘ঠিলি ধুয়ে দে বউ গাছ কাটিতে যাবো’। বৃক্ষপ্রেমিক জীবনানন্দর ভাষায় মূর্ত হয়েছে ‘বসেছে বালিকা খজ্জর্ূুরছায়ে নীল দরিয়ার কুলে’। খেজুরগাছকে কেন্দ্র করে অনেক শহর বন্দরের নান্দনিক নামকরণও আছে। তাই খেজুরগাছ বিলীন হবার নয়।