বাসস দেশ-১৬ : নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেন কুষ্টিয়ার এসপি : আপাতত ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি

99

বাসস দেশ-১৬
এসপি-হাইকোর্ট
নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেন কুষ্টিয়ার এসপি : আপাতত ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি
ঢাকা, ২৫ জানুয়ারি, ২০২১ (বাসস): কুষ্টিয়া ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচনকালীন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে ‘অসৌজন্যমূলক’ আচরণে অনুতপ্ত বলে হাইকোর্টে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলেন কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম তানভীর আরাফাত।
গত ২০ জানুয়ারি দেয়া হাইকোর্টের তলব আদেশ অনুয়ায়ী আজ আদালতে হাজির হন এসপি তানভীর। তিনি আইনজীবীর মাধ্যমে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে বক্তব্য দাখিল করেন।
আজ বিচারপতি মামনুন রহমান ও বিচারপতি খিজির হায়াত সমন্বয়ে গঠিত একটি হাইকোর্ট বেঞ্চ বিষয়টি নিয়ে শুনানি করেন ও পরবর্তী আদেশের জন্য ১৭ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেন। আপাতত ওই এসপিকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
ওই নির্বাচনে ভেড়ামারা পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করা প্রিজাইডিং কর্মকর্তা মো. শাহজাহান আলী এবং তার পরিবারের সদস্যদের ওই সময় পর্যন্ত নিরাপত্তা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রিজাইডিং অফিসারের পক্ষে আইনজীবী অনিক আর হক আদালতের এ আদেশের কথা বাসসকে জানান।
আদালতে এসপি এস এম তানভীর আরাফাতের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মুনসুরুল হক চৌধুরী ও আহমেদ ইশতিয়াক। প্রিজাইডিং কর্মকর্তার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী অনীক আর হক ও ইশরাত হাসান। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এটর্নি জেনারেল তাহেরুল ইসলাম।
আইনজীবী মনসুরুল হক আদালতে বলেন, পুলিশ সুপার সেদিন ম্যাজিস্ট্রেটকে চিনতে পারেননি। তাই অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়েছে। ভবিষ্যতে তিনি দায়িত্ব পালনে আরও সতর্ক হবেন। আইনজীবী আহমেদ ইশতিয়াক এসপির লিখিত আবেদনটি আদালতে উপস্থাপন করেন।
লিখিত বক্তব্যে এসপি বলেন, বিচার বিভাগের জন্য তার মনে সর্বোচ্চ সম্মান রয়েছে। কোনো অবস্থাতেই বিন্দুমাত্র অসম্মান দেখানোর কথা দূরে থাক, বরং বিচার বিভাগের দেয়া কাজে নিয়োজিত হতে পারলে নিজেকে সম্মানিত বোধ করেন তিনি। এ ঘটনায় তিনি মনের গভীর থেকে অনুতপ্ত। আদালতের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন এসপি।
এ সময় আদালত এসপিকে বলেন, পুলিশকে কথায় নয় কাজে পটু হতে হবে। কে কোন মতাদর্শের, কোন দলের সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। সর্বস্তরের জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা পুলিশের দায়িত্ব। কারো জন্য ভীতিকর না হয়ে তাদের কর্মকান্ডে মানুষের বন্ধু হতে হবে। আদালত বলেন, পত্র-পত্রিকায় যা দেখলাম, তা যদি কুষ্টিয়ার বাস্তব চিত্র হয়, তা হবে জাতির জন্য ভয়ঙ্কর। এমন যাতে মানুষের মনে না হয় যে দেশ পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। দেশকে পুলিশি রাষ্ট্র বানাবেন না। জাতি উৎকণ্ঠিত, তা নিরসন করার দায়িত্ব আপনাদের।
আদালত বলেন, সমাজকে শান্তিপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যেতে হবে। আইনের শাসন, বিচার ব্যবস্থা একা পূর্ণাঙ্গতা পায় না। রাষ্ট্রের সব অঙ্গ একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এ জন্য কথায় পটু না হয়ে, কাজ করতে হবে।
এসপির পক্ষে দেয়া বক্তব্যে বলা হয়, তিনি ওই দিন ম্যাজিস্ট্রেটকে চিনতে পারেননি। তাই অনিচ্ছাকৃত ভুল হয়েছে। ভবিষ্যতে তিনি দায়িত্ব পালনে আরও সতর্ক হবেন। এ সময় আদালত এসপিকে বলেছেন, বিচার বিভাগের প্রতি আপনাদের মনোভাব আগামী দিনের কর্মকান্ডে কতটা প্রতিফলিত হয় সেটা দেখতে চাই। পরে আদালত তাকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে সাময়িক অব্যাহতি প্রদান করেন।
এর আগে গত ২০ জানুয়ারি কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার (এসপি) এস এম তানভীর আরাফাতকে তলব করেন এ হাইকোর্ট বেঞ্চ। এ সংক্রান্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে আদালত স্বপ্রণোদিত ওই আদেশ দেন।
হাইকোর্ট ওই দিন আদেশের পর্যবেক্ষণে বলেন, একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা যিনি আইন ও সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী বিচারিক দায়িত্ব পালন করছেন, তার সাথে পুলিশ সুপারের এমন আচরণ ও শব্দচয়ন গুরুতর আদালত অবমাননার সামিল। তার এই ধরনের আচরণ বিচার প্রশাসন তথা বিচার বিভাগের ওপর মারাত্মক আক্রমণ। সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তানভীর আরাফাতের প্রতি তার (এসপির) এই আচরণ এড়িয়ে যাওয়া যায় না এবং এটি হালকাভাবে নেয়া যায় না। কারণ তিনি (এসপি) শুধু আদালত অবমাননাই করেননি তিনি তার কথা ও আচরণের মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে বিচার বিভাগের মর্যাদা ক্ষুণœ করেছেন।
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচন চলাকালীন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মহসীন হাসানের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ সংক্রান্ত বিষয় ব্যাখ্যা দিতেই এসপি এস এম তানভীর আরাফাতকে তলব করা হয়। আজ ২৫ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ১০ টায় এসপিকে হাইকোর্টে হাজির হয়ে বিষয়টির ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। সে অনুযায়ী এসপি হাজির হয়ে আজ ব্যাখ্যা দেন।
কুষ্টিয়ার ভেড়াামারা পৌরসভা নির্বাচন চলাকালীন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মহসীন হাসানের সঙ্গে জেলার এসপির অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ নির্বাচন কমিশন বরাবর পেশ করা হয়। গত ১৬ জানুয়ারি কুষ্টিয়া ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচন চলাকালীন ওই ঘটনায় এসপি তানভীর আরাফাতের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন দাখিল করা হয়।
এ আবেদনের কপি সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ে পাঠানো হয়। অভিযোগের অনুলিপি আইন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) দপ্তরেও পাঠানো হয় বলে জানা গেছে।
আবেদনে কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মহসিন হাসান বলেছেন, ‘কুষ্টিয়া ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচনে জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালনের সময় ভেড়ামারা পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করি। সেখানে কয়েকজনকে ভোটকেন্দ্রের বুথের ভেতর পোলিং এজেন্টদের সাথে বসে থাকতে দেখি। তাদের পরিচয়পত্র দেখাতে বললে তারা প্রিজাইডিং অফিসারের স্বাক্ষরিত এ ফোর সাইজের কাগজ দেখান।’
প্রিজাইডিং অফিসাসের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার সময় ওই কেন্দ্রে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এস এম তানভীর আরাফাত ৪০/৫০ জন ফোর্সসহ আসেন। তিনি প্রবেশ করেই প্রিজাইডিং অফিসারকে উচ্চস্বরে তলব করেন। সেসময় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমানসহ কয়েকজন ফোর্স প্রিজাইডিং অফিসারকে আমার সাথে কথা বলতে না দিয়েই তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য চাপাচাপি করেন। একপর্যায়ে পুলিশ সুপার তানভীর আরাফাত আমাকে জিজ্ঞেস করেন আপনি কে? কি করেন এখানে? আমি আমার পরিচয় দিলে তিনি আরও ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, আপনি এখানে কি করেন? বেয়াদব, বের হয়ে যান। পুলিশ সুপার ও তার ফোর্সদের আক্রমণাত্মক, চরম অসৌজন্যমূলক ও মারমুখী আচরণে হতচকিত ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তখন দাঁড়িয়ে থাকি। এরপর এসপিসহ তার ফোর্সরা আমার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে উদ্দেশ করে একাধিকবার বলেন, এসব লোককে পাঠায় কে? বেয়াদব ছেলে। এখানে কাজ কি আপনার? বের হয়ে যান এখান থেকে। তারা কেন্দ্র থেকে চলে যাওয়ার পর আমি বিষয়টি ভেড়ামারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও রিটার্নিং কর্মকর্তাকে অবহিত করি।’ আবেদনে
জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জেলার পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) নির্বাচন বিধিমালা-২০১০ লংঘনের অভিযোগ এনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার দাবী পেশ করেছেন।
এছাড়াও ওই ভোট কেন্দ্রের প্রিজাডাইং অফিসার মো. শাহজাহান আলীকে আজ ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত নিরাপত্তা বিধানে ২১ জানুয়ারি হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দিয়েছিল। ডেপুটি এটর্নি জেনারেল সরোয়ার হোসেন বাপ্পী সাংবাদিকদের জানান, ভেড়ামারা পৌর নির্বাচনের একটি কেন্দ্রের নির্বাচনী কর্মকর্তা মো. শাহজাহান আলী ও তার পরিবারকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত নিরাপত্তা বিধানে নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। ওইদিন নির্বাচনী কর্মকর্তা আদালতকে জানান, তাকে গোয়েন্দা পুলিশ তুলে নিয়ে কাগজ পত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। তিনি নিরাপত্তাহীনহায় রয়েছেন। আদালত বিষয়টি আমলে নিয়ে নির্বাচনী কর্মকর্তা মো. শাহজাহান আলীর নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে আদেশ দেয়। আজ আদালত ওই নির্বাচনী কর্মকর্তা ও স্থানীয় গনমাধ্যমকর্মীর নিরাপত্তার বিষয় নিশ্চিত করতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে আদালত বলে জানান আইনজীবী অনিক আর হক।
বাসস/এএসজি/ডিএ/১৬২০/-এএএ