মুজিবনগরে বাংলাদেশটাকে দেখা যায়

333

॥ দিলরুবা খাতুন ॥
মেহেরপুর, ১১ এপ্রিল, ২০১৮ (বাসস) : বঙ্গবন্ধুর নামানুসারের মেহেরপুরের মুজিবনগরে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ মানিচিত্রে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশটাকে দেখা যায়। মেহেরপুরের ঐতিহাসিক মুজিবনগর এখন দর্শনীয় স্থান। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অসংখ্য ভাস্কর্য্যে সাজানো হয়েছে। এখানে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্মৃতি মানচিত্র ও জাদুঘর তৈরি করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পুরো চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। দেখানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর ধ্বংসষজ্ঞ ও নারী নির্যাতনের চিত্র। নির্মিত মানচিত্রের চর্তুদিক ঘিরে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘটনা ও ধ্বংসলীলার বিভিন্ন চিত্র ম্যুরাল ভাস্কর্য্যরে মাধ্যমে তুরে ধরা হয়েছে। কিন্তু সাধারণ দর্শনাথীদের দেখার জন্য আজও তা আনুষ্ঠানিকভাবে চালু না হলেও নতুন করে ২৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
নির্মিত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও তার অবস্থা : মুজিবনগরে বিশাল একটি আমবাগান ছাড়া দেখার তেমন কিছুই ছিল না। এখন মুজিবনগর সেজেছে দেশের স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় মূর্তমান প্রতীক হয়ে। শত কোটি টাকা ব্যয়ে এখানে নানা অবকাঠামো উন্নয়নসহ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্মৃতি মানচিত্র ও জাদুঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও এখানে কিছু বহুতল আধুনিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে ১১ বছর আগে। যেমন, পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পর্যটন মটেল ও শপিং মল, সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে শিশু পল্লী, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে মসজিদ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পোস্ট অফিস ও টেলিফোন অফিস, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে আভ্যন্তরীন রাস্তাা ও হেলিপ্যাড, এবং বনও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ৬ দফা ভিত্তিক গোলাপ বাগান নির্মাণ করা হয়েছে। টেলিফোন একচেঞ্জ ও শিশুপল্লী ছাড়া এর কোনটিই আনুষ্ঠানিকভাবে চালু না হওয়ায় অব্যাবহৃত অবস্থায় অযতেœ পড়ে আছে সবকিছু।
নির্মিত মানচিত্র ও জাদুঘরে যা কিছু আছে : এখানে নির্মিত সবুজ বুকের উপর উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বাংলাদেশের স্মৃতি মানচিত্র। মানচিত্রের বুকে মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরকে দেখানো হয়েছে। তার মধ্যে তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে দেশের বেনাপোল, বনগাঁও, বিরল, নেত্রকোনাসহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে শরণার্থী গমন, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ধ্বংস, আসম আব্দুর রবের পতাকা উত্তোলন, শাহজাহান সিরাজের ইশতেহার পাঠ, শালদাহ নদীতে পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখ যুদ্ধ, কাদেরীয়া বাহিনীর জাহাজ দখল ও যুদ্ধ, পাক বাহিনীর সাথে কামালপুর, কুষ্টিয়া ও মীরপুরের সম্মুখ যুদ্ধ, শুভপুর ব্রিজের দুপাড়ের মুখোমুখি যুদ্ধ, চালনা ও চট্টগ্রাম বন্দর ধ্বংস, পাহাড়তলী ও রাজশাহীতে পাক বাহিনীর হত্যাযঞ্জ, জাতীয় শহীদ মিনার ধ্বংস, জাতীয় প্রেসক্লাবে হামলা, সচিবালয়ে আক্রমণ, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও জগন্নাথ হলের ধ্বংসযজ্ঞ, তৎকালীন ইপিআর পিলখানায় আক্রমণ, রায়ের বাজার বধ্যভূমি, বুদ্ধিজীবী হত্যা।
মানচিত্রের চর্তুদিকে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের সাহসী নের্তৃত্ব এবং ভূমিকার ছবিসহ ৪০টি ভাস্কর্য্য শিল্প কর্ম নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মধ্যে তৎকালীন সেনাপ্রধান, উপপ্রধান, বীর উত্তমদের, জাতীয় চার নেতার, তারামন বিবি, সেতারা বেগমের মূর্তমান ছবিসহ ব্রঞ্চের তৈরি ২৯টি অবক্ষ ভাস্কর, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ৩০ নেতার তৈলচিত্র রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীর বর্বরতা, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী অবদান ও জীবনবাজি এবং মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন নেতাদের দেশপ্রেম। কিন্তু আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন না হওয়ায় এ ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলোর মূর্তমান নিদর্শনগুলো সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হয়নি।
বর্হিরাংশ সাজানো হয়েছে যেভাবে : মানচিত্রের বাইরে বড় ম্যুরালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, ২৫ মার্চের কালো রাত্রির হত্যাযজ্ঞ, পাক বাহিনীর হাতে নারী নির্যাতন ও সম্ভ্রমহানী, মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ’৭১-এর ১৭ এপ্রিল এ মুজিব নগরে দেশের প্রথম সরকারের শপথ ও সালাম গ্রহণ, মেহেরপুরের স্থানীয় ১২ আনসার সদস্য মুজিবনগর সরকারের উপ-রাষ্ট্রপতি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ মুজিবনগর সরকারের নেতৃবৃন্দকে গার্ড অব অনার প্রদান, সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় ১১ জন সেক্টর কমান্ডারদের গোপন বৈঠক, মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডারদের সেক্টর বন্টন সভা ছাড়াও অরোরা নিয়াজী ও একে খন্দকারের উপস্থিতিতে পাক বাহিনীর আত্মসর্মপনের চিত্র নির্মিত ভাস্কর্য্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ভাস্কর্যগুলো (লাইফ সাইজের) মানুষ সমান আকৃতির।
এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব : উল্লেখ্য, ’৭১ সালের ১৭ এপ্রিল এ মুজিবনগরের বিশাল আম্রকুঞ্জে কঠোর গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার মধ্যে মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহণ ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ অনুষ্ঠান হয়েছিল। এখানেই এজিএম ওসমানিকে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। এ মুজিবনগর সরকারই দেশের ৯ মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনা করে। সেদিন দেশ স্বাধীন করে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের নাম স্থান করে দিয়েছিল মুজিবনগর সরকার। সেই স্বীকৃতিস্বরূপ সেদিন মুজিবনগরকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। এর আগে মুজিবনগর বৈদ্যনাথবাবুর আমবাগান হিসেবে পরিচিত ছিল।
গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোক্তার হোসেন দেওয়ান জানান, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসের আগে প্রতিবারের ন্যায় এবারও ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কার কাজ চলছে। নতুন করে ২৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে সেখানে লেক, প্রশাসনিক অফিস, আবাসিক ভবন, পর্যটকদের জন্য পাকির্ং ইত্যাদি নির্মাণ করা হবে।
মেহেরপুর জেলা প্রশাসক পরিমল সিংহ জানান, আসলে মুজিবনগরে নির্মিত প্রকল্প আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন না হলেও মুজিবনগরকে আরও কিভাবে সাজানো যায় সেই প্রচেষ্টা চলছে। নতুন করে ২৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে।