ভোলায় শীতের সকালে দেখা মিলছেনা খেজুর রস বিক্রেতাদের

289

।। হাসনাইন আহমেদ মুন্না ।।
ভোলা, ১৭ জানুয়ারি, ২০২১ (বাসস) : শহরে শীতের সকালে দেখা মিলছেনা খেজুরের রস বিক্রেতাদের। ঘন কুয়াশা ও তীব্র শীতের মধ্যে কাঁধে রসের হাড়ি নিয়ে রসওয়ালাদের হাঁক ডাক শোনা যায়না আগের মতো। এমনকি রস বিক্রেতাদের বাড়ি গিয়েও রস পাওয়া দুস্কর হয়ে পড়েছে। তাই জমে উঠছেনা শীতের সকালে রোদে বসে আয়েশ করে পিঠা-পায়েস খাওয়া। জেলার বিভিন্ন উপজেলায় গাছিরা পেশা পরিবর্তনের ফলে আগের মতো আর রস সংগ্রহ করা হয়না। একসময় নির্বিচারে খেজুর গাছ কাটার ফলে কমে গেছে খেজুর গাছের সংখ্যা। তারপরেও উপকূলের প্রত্যন্ত এলাকায় কিছু কিছু স্থানে খেজুর গাছ কাটা হয়। পর্যাপ্ত চাহিদার তুলনায় রস পাওয়া যায় অপ্রতুল।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যাক্তিরা জানিয়েছেন, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের সাথে খেজুরের রস ও শীতকাল একাকার হয়ে আছে। এখানে শীতের মূল উৎসবই হলো শীতের পিঠা। যার মূল উপাদন খেজুরের রস, গুড় ও পাটালী। আর শীতের সকালে রোদে বসে মুড়ি, খই, পিঠা খেতে কার না ভালো লাগে। তাই এসময় গ্রামের ঘরে ঘরে পিঠা ও পায়েস তৈরির ধুম পড়ে যেত। শিশু, যুবক, বৃদ্ধ সবাই মেতে উঠে নতুন চালের পিঠা খাওয়ার উৎসবে। যদিও নাগরীক কোলাহলে বর্তমান প্রজন্ম ভুলতে বসেছে সেই স্বাদ।
গাছিরা জানান, গাছের মাথায় একই স্থানে অনেকখানি বাকল তুলে সেখানে হাড়ি বেঁধে নালার (বাঁসের তৈরি) সাহায্যে এ রস সংগ্রহ করা হয়। রাতে হাড়ি রেখে যায় গাছিরা। আর প্রতিদিন ভোরে ঘন কুয়াশার মধ্যে গাছ থেকে রসে ভরা হাড়ি নামানো হয়। পুরো এলাকা তখন কাচা রসের গন্ধে মৌ-মৌ করে। এসময় বিভিন্ন ধরনের পাখিরা গাছে ভিড় করে রস খাওয়ার জন্য। এসব রসের হাড়ি মান ভেদে ১৫০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি করা হয়।
উপজেলা সদরের তেঁতুলীয়া নদী পাড় সংলগ্ন গ্রাম বালীয়ার গাছি জয়নাল আবেদিন ও কাসেম ফরাজী বলেন, জেলার বিভিন্ন উপজেলার গ্রামগুলোতে আজ থেকে ২০ বছর আগেও গাছ থেকে প্রচুর পরিমান রস সংগ্রহ হতো। বিশেষ করে প্রত্যান্ত অঞ্চলে বেশি করে খেজুর রস আহরণ হতো। কিন্তু বর্তমানে খেজুর গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। তারা বলেন, তাই অনেকেই আগাম রসের জন্য অগ্রীম টাকা দিয়ে রেখেন। সেই টাকায় কেউ কেউ রস সংগ্রহের সরাঞ্জম ক্রয় করে এখন গাছ কাটায় ব্যস্ত। আবার এখন যেহেতু রসের চাহিদা বেশি তাই এর দামও বেশ ভালো পান। তবে গাছ কমে যাওয়াটাই তাদের সংকট।
বাপ্তা গ্রামের গুড় ব্যবসায়ী মো: আলী হোসেন বলেন, একসময় শীতের মৌসুমে তিনি শতাধিক মণ গুড় উৎপাদন করতেন রস দিয়ে। কিন্তু বর্তমানে রস সংকটের কারণে তা অতি সামন্যতে ঠেকেছে। বেশি দামে রস ক্রয় করে উৎপাদিত গুড়ের বেশি দাম পাওয়া যাচ্ছেনা। তাই এ পেশা বদলানোর কথা চিন্তা করছেন তিনি।
গাছ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে ইটভাটার মালিক মো: নোমান হোসেন বলেন, ইটভাটায় খেজুর গাছ খুব ভালো জ্বলে। এর দাম কম হওয়ায় এক সময় ইটভাটা মালিকরা প্রচুর খেজুর গাছ জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করেছে। তবে গত ৬/৭ বছর আগেই সরকার ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করেন। ফলে কিছু খেজুর গাছ এখোনো টিকে রয়েছে। কিন্তু জ্বালানি হিসেবে খেজুর গাছ অধিক ব্যবহারে মূলত এ গাছটির সংখ্যা হৃাস পেয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
ভোলা প্রেসক্লাব সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এম. হাবিবুর রহমান (৮০) বলেন, আগে গাছিরা নিজেরাই রস বয়ে এনে বাসায় দিয়ে যেত। আর এখন তাদের বাড়ি যেয়েও কাঙ্খিত রস পাওয়া যায়না। তাই বদলে যাচ্ছে মেয়ে -জামাইদের পিঠা পায়েস দিয়ে আপ্যয়ণের রীতি। গ্রাম বাংলার এ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে সরকারের উদ্যেগের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে খেজুর গাছ রোপণের উপর জোর দেন।
এদিকে শীতের সময় গ্রামের গাছি পরিবারগুলোর দৃশ্যপট অনেকটাই বদলে যায়। বাড়ির উঠানের একপাশে স্তুপ করা থাকে ছোট বড় রসের অগনন হাড়ি। পুরুষরা গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। গেরস্থ বাড়িতে মহিলারা বাড়ির উঠানে জলন্ত উননে মস্ত পাত্রে রস শোধন করে রাত জেগে। এর মাধ্যমে রসের মিষ্টি গুড় তৈরি করা হয়। আর গুড় হচ্ছে পিঠা, পায়েশ ও নাস্তার প্রধান উপাদান। এসময় পুরো এলাকা খেজুরের রসের মোহনীয় গন্ধে ভরে উঠে।