বাসস দেশ-৩ : স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটাচ্ছেন কুমিল্লার শ্রমজীবীরা

147

বাসস দেশ-৩
কুমিল্লা-শ্রমজীবীরা
স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটাচ্ছেন কুমিল্লার শ্রমজীবীরা
।। কামাল আতাতুর্ক মিসেল।।
কুমিল্লা (দক্ষিণ), ৫ জানুয়ারি, ২০২১ (বাসস) : জেলার শ্রমজীবীরা এখন স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটাচ্ছেন। শ্রমজীবীদের এখন আর আগের মতো কাজের জন্য ছুটোছুটি করতে হচ্ছে না। হাতের নাগালেই মিলছে কাজ। বিগত ক’য়েক মাস করোনার জন্য ঘরে বন্দি থাকলেও এখন চারিদিকে বিরাজ করছে একটা কর্মমুখর পরিবেশ। এখন মাঠে-ঘাটে সর্বত্র কাজ আর কাজ। বেড়ে গেছে পারিশ্রমিকও। যার ফলে কুমিল্লার প্রায় আট সহ¯্রাধিক নির্মাণ ও কৃষি শ্রমিকের মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকায় কৃষি শ্রমিক, বিভিন্ন কনস্ট্রাকশান ভবনে কর্মরত নির্মাণ শ্রমিকদের সাথে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া যায়। দেশে করোনা বিস্তারের পূর্বের মতো না হলেও ধীরে ধীরে সচল হতে শুরু করেছে তাদের উপার্জন। গত কয়েকদিনে সরেজমিনে কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায় বিভিন্ন কনস্ট্রাকশান ভবনের কাজ করছেন নির্মাণ শ্রমিকরা। কেউবা রড কাটছেন, কেউবা বালি ও পাথর খাড়িতে ভরছেন, আবার কেউ কেউ ঢালই কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। এর আগে দেশে করোনার বিস্তার শুরু হলে গত ২৫ মার্চ থেকে দেশের সব দোকান এমনকি বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানসহ বন্ধ হয়ে যায় কুমিল্লার কনস্ট্রাকশান বিল্ডিংয়ে কাজ। এতে বিপদে পড়ে যান এসব নির্মাণ শ্রমিকরা। প্রায় তিন মাসেরও বেশি বন্ধ থাকার পর পুনরায় সেইসব বিল্ডিং গুলোতে পুরোপুরি ভাবেই কাজ শুরু হওয়ায় আবারও বৃদ্ধি পাচ্ছে শ্রমিকের চাহিদা তাদের মাঝে ফিরে এসেছে স্বস্তি। এতে তাদের আয়ও সচল হওয়ায় নিজেদের ভাগ্য যেমন পাল্টাচ্ছেন তেমন অর্থনীতির চাকা সচল রাখছে এসব শ্রমিকরা।
কুমিল্লার আনন্দধারা কনস্ট্রাকশান ভবনে শ্রমিকের কাজ করছেন লক্ষীপুরের জাবেদ। তিনি বাসসকে বলেন, করোনায় দেশের সব দোকানপাঠসহ বিভিন্ন শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আনন্দধারা কনস্ট্রাকশান ভবনের কাজও বন্ধ হয়ে যায়। এতে আমরা একেবারেই বেকার হয়ে পড়ি। গত দুইমাস পুনরায় কাজ শুরু হওয়ায় এতে আমাদের মত শ্রমিকের চাহিদা আগের মতো বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইনকামও ভালো হচ্ছে। অপর শ্রমিক মনির হোসেন বলেন, করোনার আগে দিনপ্রতি আমরা কাজ করে ৭০০-৮০০ পেতাম। এখন আবার পুনরায় কাজ শুরু হওয়ায় এখনও সেই পরিমানে টাকা ইনকাম করি। তিনি আরও বলেন, করোনায় অনেকদিন খারাপ গেছে, এখন আমাদের কোন অসুবিধা নেই বলেও জানান তিনি।
এদিকে কুমিল্লার শ্রমিকদের একটি বড় অংশ দিনমজুর। তারা প্রতিদিনের মজুরিতে কাজ করেন। বিশেষ করে কৃষি, নির্মাণ শিল্প এবং উন্নয়নমূলক কাজে’র শ্রমিকরা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করার ফলে এখন কৃষি শ্রমিকরা সাচ্ছন্দে দিন কাটাচ্ছেন। তোফায়েল আহমেদ সকালে ঘুম থেকে ওঠে বাড়িতে টুকিটাকি কাজ সেরেই রওনা হন মাঠের দিকে। উদ্দেশ্য কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করা। এ কাজে যে অর্থ তিনি আয় করেন তা ব্যয় করেন সংসারে। ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ দিয়ে হাতে যা থাকে তা দিয়ে ঘরবাড়ির উন্নয়নে ব্যয় স্বাচ্ছদ্যে করছেন তিনি। কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার পোম্বাশ গ্রামে স্ত্রী সন্তান নিয়ে তার বসবাস। জানতে চাইলে এ প্রতিবেদকের কাছে তোফায়েল বলেন, আমার এক ছেলে দুই মেয়ে। সন্তানদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য মাঠে ঘাটে কাজ করছি। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত মানুষের জমিতে কাজ করি। কাজও বিস্তর, এক বেলা খাবার দিয়ে ৫৫০ টাকা হাজিরা পাচ্ছি। তোফায়েল আহমেদ এর মতো এ এলাকার প্রায় প্রত্যেক এমন নানা কজে নিয়োজিত আছেন। তারা যেমন পরিশ্রমী তেমনি সময়নিষ্ঠ। সংসারে তারা নীরবে অবদান রেখে চলেছেন। তীব্র শীত, ঘন কুয়াশা, রোদ, বৃষ্টি, ঝড়কে উপেক্ষা করে তাদের সংগ্রামী পথ চলা। বদলে ফেলছেন নিজের ভাগ্য। তাদের কর্মচেষ্টায় বলতে যাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতিও।
কুমিল্লার দাউদকান্দি এলাকার এক স্কুল শিক্ষক সাইফুল ইসলাম। তিনি বাসসকে জানান, এ এলাকার এক সময় অভাবের তাড়নায় অনেক খেটে খাওয়া মানুষকে কাঁচি, নিড়ানী, দা ও কোদাল নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা হাট-বাজারে শ্রম বিক্রি করার জন্য বসে থাকতে হতো। কিন্তু এখন এ দৃশ্য খুব কমই চোখে পড়ে। এখন দিন বদলেছে, কাজ ও পারিশ্রমিকও বেড়ে গেছে দ্বিগুন। যার ফলে এখানকার কৃষি, নির্মাণ এবং উন্নয়ন কাজের শ্রমিকরা ভালোই আছেন। গত কয়েকদিনে কুমিল্লার বেশ কয়েকটি জেলার কৃষি মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, কৃষি শ্রমিকরা বেশ ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। রোপা আমন ধান কাটার পর বোরো ধানের বীজতলা তৈরী, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল আবাদ ও উৎপাদন কাজ করছেন কৃষি শ্রমিকরা।
কুমিল্লার বৃহৎ সবজির আড়ত নিমসার। আড়তকে কেন্দ্র করে প্রতিদিন সবজি আর কাঁচা তরিতরকারি বোঝায় ট্রাক কুমিল্লার নিমসার আসে মাঝ রাতে। তাই প্রতিরাতেই ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকিতে সরগরম হয়ে উঠে নিমসার বাজার। এ মালামাল খালাস করা থেকে শুরু করে বৃহত্তর কুমিল্লার প্রতিটি ঘরে ঘরে সবজি পৌঁছে দেওয়ার কাজটা করে এখানকার শ্রমিকরা। এ শ্রমিকদোর কাজের সময় রাত ২টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত। এ সময় তারা এতোটাই ব্যস্ত হয়ে উঠে যে কথা বলার সুযোগ দিতে পারে না। দিনের বেলায় অনেকে শান্তির ঘুম দেয়, অনেকে আবার জীবিকার সন্ধানে অন্য কাজে লেগে পড়ে। এমনই একজন শ্রমিক ইকবাল। গ্রামের বাড়ি চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে ১ বছর আগে কুমিল্লায় এসেছেন। গতকাল রাত ১০টার দিকে নিমসার বাজার গিয়ে তার মতো অনেক শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয়। জানতে চাইলে ইকবাল বাসসকে বলেন, তিনি প্রতি রাতে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় করেন। বোঝা প্রতি পান ১৫ থেকে ২০ টাকা। প্রতি রাতে প্রায় ৩০ ঝুড়ি মালামাল টানতে পারেন তিনি। অপর শ্রমিক গাইবান্ধার আমিরুল জীবিকার অন্বেষণে কুমিল্লায় এসেছেন কয়েক বছর আগে। নিমসার বাজারে রাতে সবজির বোঝা টেনে তার আয় রোজগার ভালই হয়। তিনি বলেন, প্রতি দিন থাকা খাওয়া বাবদ ৬০ টাকা খরচ যায়। বাকি টাকা পরিবারের জন্য জমে। কুমিল্লার নিমসার বাজারে এমন কতোজন শ্রমিক কাজ করে তার সঠিক সংখ্যা কেউ বলতে পারলেন না। এখানে অনেকে অস্থায়ীভাবে কাজ করতে গ্রাম থেকে আসে। টাকা পয়সা জমিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। তবে এখানকার আড়তদার রতন চৌধুরী বাসসকে জানালেন, এ শ্রমিকদের সংখ্যা ৪ থেকে ৫শ’র মতো। তারা প্রত্যেকেই মাস শেষে ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা উপার্জন করতে পারছে। এ টাকা নিয়ে পরিবার-পরিজনকে নিয়ে বেশ সুখেই দিন কাটছে আর অপরদিকে এদের কল্যাণেই কুমিল্লাসহ আশপাশের জেলাগুলোয় প্রতিদিন সকালে ঘর ভরে যায় টাটকা সবজিতে।
বাসস/এনডি/সংবাদদাতা/১১২০/নূসী