পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধ করতে হবে

1144

ঢাকা, ৫ ডিসেম্বর.২০২০(বাসস): রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রামে বন্যা শুরু হওয়ার পর বেড়ে গিয়েছিল জনদুর্ভোগ। গত ২৭ নবেম্বর পর্যন্ত বন্যাজনিত বিভিন্ন কারণে ২২ জনের প্রাণ গেছে। এদের ১৭ জনই শিশু। মৃত্যুহারের হিসাবে যা ৮০ শতাংশ।
গত কয়েক বছরে চিত্রটা কেমন? আমরা দেখছি, দেশব্যাপী পানিতে পড়ে অথবা পানিবাহিত রোগে শিশুমৃত্যুর হার দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। মর্মান্তিক এ পরিস্থিতি সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর জন্য অন্তহীন কষ্ট, শোক ও দুঃখযাতনার উৎস।
কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারি উপজেলার রমনা ইউনিয়নের এক বাসিন্দা আনিসা বেগম। সম্প্রতি ওয়াপদা বাঁেধ আশ্রয় নিতে হয় তাদের। বানভাসি এই পরিবারটির সেখানে না যেয়ে উপায় ছিল না।
কিন্তু সেখানে যাওয়ার মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই আনিসা হারান তার সন্তানকে। এক শুক্রবারে তিনি যখন অপর এক দুধের শিশুকে কোলে নিয়ে রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলেন, তখনই ঘটে যায় সর্বনেশে ঘটনা। দশবছর বয়সী মেয়ে বাঁধের অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলছিল। হঠাৎই সে বাঁধের উপর থেকে পড়ে যায় নদীতে। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা অনেক খোঁজাখুঁজি করে লাশ উদ্ধার করে।
এরকম শোকাবহ ঘটনা প্রায়শই ঘটছে দেশের বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকায়। এসব এলাকার পরিবারগুলো মূলত বাধ্য হয়ে আশ্রয় নেয় খোলা আকাশের নিচে রাস্তায় অথবা বাঁধে। বন্যাপ্লাবিত এলাকার অধিকাংশ অসহায় মানুষকেই খোয়াতে হয় ফসল, গবাদিপশু এবং তাদের ঘর-বাড়ি।
কুড়িগ্রাম সিভিল সার্জন অফিসের তথ্যঃ বন্যার মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এই উপদ্রুত এলাকায় ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে ১৭ জনই শিশু। এটি প্রায় মোট মুত্যুর ৮০ শতাংশ। যদিও অন্যান্য বন্যাকবলিত এলকার সঠিক পরিসংখ্যান নেই কারো কাছে। তবুও ধারণা করা যায় যে, প্রায় সবকটি বন্যা কবলিত এলকার চিত্র মোটামুটি একই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) মতে, বিশ্বের যে ক’টি দেশে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
গত ১১ মে ২০২০ জনস হপকিন্স ইন্টারন্যাশনাল ইনজুরি রিসার্চের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশে এক থেকে চার ছর বয়সী শিশুমৃত্যুর মধ্যে ৪২ শতাংশের প্রাণ যায় পানিতে ডুবে।
ব্লুমবার্গ স্কুলের আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ওলাকুনলে এলঙ্গে’র এক গবেষণা অনুযায়ী, প্রতি ঘন্টায় এক থেকে চার বছর বয়সী শিশুর মধ্যে প্রায় দু’জন শিশুর মৃত্যু ঘটে পানিতে ডুবে। তিনি এজন্য কমিউনিটি-ভিত্তিক ডে-কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। তার মতে, ডে-কেয়ার সেন্টার কর্মীরা সদা সতর্ক থাকায় পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার রোধে খূব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তার এ গবেষণার ফলস্বরূপ ৩,২০০টি ডে-কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়। এবং ৬৪,০০০ শিশুর উপর এ গবেষণা পরিচালিত হয়। গবেষণা মতে, দেশের গ্রামীণ পর্যায়ে গৃহভিত্তিক কমিউনিটি নেতৃত্বের ফলে নয় মাস থেকে ৪৭ মাস বয়সী শিশুমৃত্যুর হার ৮৮ শতাংশ কমানো সম্ভব।
ইউনিসেফের সুমনা শাফিনাজ বলেন, বন্যার মত বড় দুর্যোগের সময়কালীন সব দুর্ঘটনার খবর কিন্তু পাওয়া যায় না। কারণ, এসময় মূলত এসব এলাকা দেশের অন্য এলাকা থেকে একপ্রকার বিচ্ছিন্ন থাকে।
তিনি বলেন, প্রায় দুই তৃতীয়াংশ দুর্ঘটনা ঘটে যখন শিশুরা একা থাকে অথবা সমবয়সী অন্য কোনো বাচ্চার সঙ্গে খেলতে যায়। কারণ, এ বয়সী শিশুদের অন্য কাউকে উদ্ধার করার মত ক্ষমতা নেই। এছাড়াও অনেক মা, বিশেষ করে বড় পরিবারে মায়েরা ব্যস্ত থাকেন বেশি। ফলে তারা সবচেয়ে ছোটদের দিকে কম নজর রাখতে পারেন। অনিবার্য কারণেই দুর্ঘটনা ঘটে যায়। পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর অধিকাংশ ঘটনায় দেখা গেছে, মা অথবা তাদের যিনি দেখভাল করছেন, তিনি ঘর সংসারের অন্যসব কাজে ব্যস্ত।
কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক রেজাউল করিম বলেন, পর্যাপ্ত দেখভালের অভাবেই মূলত পানিতে ডুবে বেশিরভাগ শিশুমৃত্যুর দুর্ঘটনা ঘটছে। যদি পরিবারের সদস্যরা বন্যার সময় আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে যান, তবে এ ধরনের পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার কমানো অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
তিনি বলেন, উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে আগাম সচেতনতা তৈরির জন্য বলা হয়েছে, যাতে তারা এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে পারেন।