বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১ : একজন সফল ইউএনও রাহেলা রহমত উল্লাহ

239

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১
নারী-ক্ষমতায়ন
একজন সফল ইউএনও রাহেলা রহমত উল্লাহ
ঢাকা, ২ ডিসেম্বর, ২০২০ (বাসস) : নিজের অফিসে খুব ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন রাহেলা রহমত উল্লাহ। যেন দম ফেলার উপায় নেই। দর্শনার্থীদের সাথে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে অফিসের বিভিন্ন কাগজপত্রেও চোখ বুলাচ্ছেন, করছেন স্বাক্ষর।
গ্রামের মেয়ে রাহেলা বেড়ে উঠেছেন গ্রামেই। এখন সরকারের অংশ হিসেবে দায়িত্বশীল পদে আসীন। দায়িত্ব পালন করছেন ইউএনও হিসেবে। এ পর্যন্ত যেখানেই কাজ করেছেন সব জায়গায় রেখেছেন দক্ষতার স্বাক্ষর। অফিসে তার দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত। নিজে বড় হয়েছেন গ্রামে। তাই গ্রামের মানুষের দু:খ-দূর্দশা ভালোই বোঝেন। আর তাই অফিসের প্রবেশ মুখেই লেখা আছে- ‘আমি এবং আমার অফিস দূর্ণীতি মুক্ত’- ইউএনও রাহেলা রহমত উল্লাহ।
রাহেলা বলেন, সব সময় আমার চেষ্টা থাকে বিভিন্ন গ্রামের সাধারন মানুষের দু:খের কথা শুনতে। তারাও আমাকে এসে সব কথা বলেন। তারপর আইনের মধ্যে থেকে যতটুকু সম্ভব সমস্যা সমাধানের করার চেষ্টা করি। যাতে করে গ্রামের সাধারন মানুষের যেন কোন ক্ষতি না হয়। এতে আবার কেউ কেউ আমার উপর রেগে থাকে। কিন্তু আমার কিছু করার নেই। কারন আইন যা বলে, তাই করতে হবে।
রাহেলার জন্ম চাঁদপুর জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার বড়কুল গ্রামে। পিতা রহমত উল্লাহ জিন্নাহ চাকরি করতেন পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে। মাতা নুরুন নাহার একই বিভাগে কর্মরত। পিতা-মাতার দ্বিতীয় সন্তান তিনি। মেধাবী ছাত্রী ছিলেন রাহেলা। আর তাই বাবা-মারও অনেক স্বপ্ন ছিল রাহেলাকে নিয়ে।
রাহেলাও নিরাশ করেননি বাবা-মাকে। তাদের স্বপ্ন পূরণে দিন-রাত পড়ালেখা করে এখন সরকারী কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, আমি নিজেও অনেক বড়ো কিছু হতে চেয়েছি। সেই বড়ো হওয়ার স্বপ্ন নিয়েই লেখাপড়া চালিয়ে গেছি। অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও নিজের প্রতি প্রবল আত্মবিশ্বাস যে কোনো মানুষকে সফলতা এনে দিতে পারে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার আকাঙ্খা যিনি প্রতিটি মুহূর্তে লালন করেন এবং এর জন্য প্রতিনিয়ত লড়াই করেন- তিনি একদিন না একদিন সফল হবেনই।
রাহেলার স্কুল জীবন শুরু হয় গাঁয়ের বড়কুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে। সেখান হতে পঞ্চম শ্রেণি শেষ করে লেখাপড়া করে বড়কুল নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি লাভ করেন। এরপর বাবা নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করান হাজীগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে এসএসসি ১৯৯৮ সালে ছয় বিষয়ে লেটারসহ বিজ্ঞান বিভাগে স্টার মার্ক অর্জন করেন। হাজীগঞ্জের মডেল কলেজ থেকে ২০০০ সালে এইচএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে উর্ত্তীণ। এরপর সমাজকল্যাণ বিষয় নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ২০০৮ সালে মাস্টার্স শেষ করে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড মডেল কলেজে প্রভাষক হিসেবে চাকরিজীবন শুরু করেন। প্রভাষকের চাকরি ছেড়ে সেই বছরের শেষের দিকেই সোনালী ব্যাংকে সিনিয়র অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। ২০১০ সালে ২৮তম বিসিএস পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হয়ে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সিলেট বিভাগে যোগদান করেন। থেমে থাকেননি এই অদম্য নারী। যেটা ছিল মা-বাবার চাওয়া পাওয়া- সেটাই করেছেন মেয়ে রাহেলা রহমত উল্লাহ।
তিনি বলেন, ২০১৩ সালে হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ২০১৩-১৪ পর্যন্ত এবং মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলা কার্যালয়ে কমর্রত ছিলাম। ২০১৫-১৬ জুন পর্যন্ত ঢাকা মহা নগরীর লালবাগ সার্কেলে, ২০১৬ এর জুন থেকে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সহকারী পরিচালক হিসেবে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ঢাকাতে কমর্রত ছিলাম। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি-সেপ্টেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত শরিয়তপুরের জাজিরা উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে কমর্রত ছিলাম। বর্তমানে সিংগাইর উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছি।
এখানে যোগদান করেই সরকারি সম্পত্তিতে অবৈধ স্থাপনা, নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, মাদক, অবৈধ ইটভাটা, বাল্যবিবাহ, খাবারে ভেজালসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে দোষীদের আইনের আওতায় আনাসহ সরকারের প্রতিটি দায়িত্ব পালনে যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি।
রাহেলা বলেন, যেহেতু ইউনিয়ন পর্যায়ে আমার বেড়ে ওঠা, তাই আমার আজকের এ অবস্থানের জন্য আমার মায়ের স্বপ্ন বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। তিনি সবসময় বলতেন, মেয়েদের নিজ পায়ে দাঁড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। অর্থনৈতিক স্বাধীনতাই পারে মেয়েদের সব নিপীড়ন থেকে মুক্তি দিতে। অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার পর বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আমার মা চিন্তিত হয়ে পড়েন আমার ক্যারিয়ার নিয়ে। বিয়ের পর ক্যারিয়ারের সফলতা নির্ভর করে স্বামীর মন-মানসিকতার ওপর। আমার স্বামীর সহযোগিতা এবং অনুপ্রেরণা না পেলে কখনোই আজকের অবস্থানে আসা সম্ভব হতো না। আমার মাস্টার্স শেষ হওয়ার পর আমার স্বামী সামছুল আলম সুমন আমাকে প্রথম শ্রেণির চাকরি ব্যতীত কোনো চাকরিতে আবেদন করতে দেননি। অধিকাংশ পরীক্ষার আগে তিনি আমাকে উৎসাহ এবং পরামর্শ দিতেন। খুব বেশি চাকরির পরীক্ষা আমাকে দিতে হয়নি। যে কয়টা পরীক্ষা দিয়েছি প্রায় সবগুলো চাকরিতেই নিয়োগ পেয়েছি। মেধা এবং পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। একে অপরের পরিপূরক, শুধু মেধা দিয়ে পরিশ্রম ছাড়া যেমন সফলতা পাওয়া যায় না, তেমনি শুধু পরিশ্রম করে মেধা না থাকলেও সফলতা আসে না। নিজের মেধা, সততা, পরিশ্রম দিয়ে দেশের উন্নয়নে কাজ করে যেতে চাই।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/সুঘো/আহো/০৯৩০/স্বব