বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১ : সচেতনতা রুখতে পারে অটিজম

358

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১
শিশু-অটিজম
সচেতনতা রুখতে পারে অটিজম
ঢাকা, ২৮ নভেম্বর, ২০২০ (বাসস) : রাইমা আর আরিফ দু’জন দুজনকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সাড়ে দশ বছর আগে। পরিবারের অমতে বিয়ে তাই শুরুতে দুই পরিবারই মেনে নেয়নি। আর তাই আলাদা সংসার তাদের। বিয়ের দেড় বছরের মাথায় গর্ভবতী হন রাইমা। খবরটি শুনেই দুই পরিবারই আস্তে আস্তে মেনে নেয় রাইমা আর অরিফকে। দেড় বছরেরও বেশী সময় পর প্রথম শ্বশুড় বাড়ী যায় রাইমা। সবাই খুবই আদর-যতœ করতে থাকে। কিন্তু বিপত্তি ঘটে মাত্র গর্ভাবস্থার মাত্র সাড়ে সাত মাসের মাথায় হঠাৎ করে ব্লিডিং শুরু হয়। দ্রুত কাছের এক ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার পর গাইনি ডাক্তার সব কিছু পরীক্ষা-নীরিক্ষার পর বলেন, দ্রুতই ডেলিভারী করাতে হবে। নয়তো বাচ্চাকে বাঁচানো যাবে না।
পরদিনই ফুটফুটে বাচ্চা হয় রাইমার। কিন্তু প্রি-ম্যাচিউর বাচ্চা, তাই বেশ কিছুদিন ইনকিউবেটর-এ রাখতে হয়। প্রায় এক মাস পর তারা ঘরে ফেরে মেয়ে রওদা’কে নিয়ে। সবার খুব আদরের। কিন্তু সাড়ে তিন বছর বয়স হয়ে গেলেও রওদা তেমন কিছুই বলতে পারেনা। এমনকি ঠিকমত দাঁড়াতেও পারে না। সব সময় নিজের মত করে থাকতে পছন্দ করে। অন্য ছোট বাচ্চা দেখলে কিছুটা খুশি হয়। কিন্তু তাদের সাথেও বেশিক্ষন খেলে না। আবার কোন কিছু একবার চাইলে সেই জিনিসই বারবার চাইতে থাকে। না পেলে অসম্ভব রেগে যায়।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের প্রফেসর ডা. মনির হোসেন বলেন, এ ধরনের শিশুরা অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু। অটিজম হচ্ছে স্নায়ুর বিকাশজনিত সমস্যা। মায়ের গর্ভ থেকে জন্মের কয়েক বছর পর পর্যন্ত শিশুর ¯œায়ুতন্ত্রের বিকাশ ঘটতে থাকে। কোনো কারণে ¯œায়ুর বিকাশ বাধাগ্রস্ত হলে শিশু অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হতে পারে।
তিনি বলেন, প্রতিটি শিশুকেই তার জন্মের পর থেকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যদি দেখা যায়- ছয় মাস বয়সের মধ্যে শিশু একা একা না হাসে, বার মাস বয়সের মধ্যে আধো আধো বোল বলতে পারছে না, পছন্দের বস্তুর দিকে ইশারা করছে না, ১৬ মাসের মধ্যে কোনো একটি শব্দ বলতে পারে না, ২৪ মাস বয়সের মধ্যে দুই বা ততোধিক শব্দ দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে না, ভাষার ব্যবহার রপ্ত করতে পারার পর আবার ভুলে যাচ্ছে, বয়স উপযোগী সামাজিক আচরণ করছে না- এসব লক্ষণ দেখা গেলে তখন তাকে অবশ্যই অটিজমের বৈশিষ্ট্য আছে কি না, বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
তিনি বলেন, অটিজম রয়েছে এমন শিশুর মধ্যে মূলত দুই ধরনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়: প্রথমত সামাজিক সম্পর্ক তৈরিতে অসুবিধা এবং আশপাশের পরিবেশ ও ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের সমস্যা এবং দ্বিতীয়ত বারবার একই ধরনের আচরণ করা।
তিনি বলেন, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তি বা শিশুরা সামাজিকতা পালন করতে পারে না, নিজের আগ্রহ, আবেগ আর অনুভূতি অপরের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে না, যেকোনো ধরনের সামাজিক সম্পর্ক শুরু করার জন্য নিজে থেকে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে না এবং যদি সে কথা বলতেও পারে, তবু আরেকজনের সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়। কেউ কেউ ঠিকমতো কথা বলতে পারে না বা একেবারেই কোনো অর্থবোধক শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না। নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয় না, চোখে চোখ রেখে তাকায় না এবং পরিবেশ অনুযায়ী মুখভঙ্গির পরিবর্তন করে না, অর্থাৎ ভয় পেলে বা খুশি হলে মুখ দেখে বোঝা যায় না। অটিজম আছে এমন শিশুরা কল্পনা করে খেলে না।
একই হাসপাতালের শিশু রোগ বিষেশজ্ঞ ডা. সাইদুর রহমান বলেন, একই ধরনের আচরণ এ ধরনের শিশুরা বারবার করতে পারে। যেমন হাতে তালি দেওয়া, মেঝেতে ঘুরতে থাকা, বারবার আঙ্গুলের সঙ্গে আঙ্গুল প্যাঁচানো। কখনোবা একটি বস্তুকে বারবার একই রকমভাবে ব্যবহার করা। যেমন খেলনা গাড়ির চাকা বারবার ঘোরানো, কখনোবা একই শব্দ বারবার উচ্চারণ করা। অটিজম আছে এমন যারা কথা বলতে পারে, তারা দেখা যায় একই প্রশ্ন বারবার করছে বা প্রশ্নকর্তার প্রশ্নটিই বারবার উচ্চারণ করছে। এই ধরনের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরা রুটিন বা প্যাটার্ন মেনে চলতে পছন্দ করে, রুটিনের ব্যতিক্রম হলে রেগে যায় বা মন খারাপ করে।
অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের মধ্যে খিঁচুনি (মৃগী), অতিচঞ্চলতা (হাইপার অ্যাক্টিভিটি), বুদ্ধির ঘাটতি, হাতের কাজ করতে জটিলতা, হজমের সমস্যা, দাঁতের সমস্যা, খাবার চিবিয়ে না খাওয়া ইত্যাদি সমস্যা থাকতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) পরিচালিত সর্বশেষ জরিপ (২০১৮ সালে প্রকাশিত) অনুযায়ী দেখা যায়, প্রতি ৫৯ জন শিশুর মধ্যে ১ জনের অটিজম রয়েছে। মেয়ে শিশুদের তুলনায় ছেলে শিশুদের অটিজমের বৈশিষ্ট্য থাকার আশংকা প্রায় ৪ গুণ বেশি। বিগত ৪০ বছরে সারা বিশ্বে অটিজমের হার বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ। এর মূল কারণ, বারবার অটিজমের সংজ্ঞা পরিবর্তন হয়েছে, ফলে অটিজমের বৈশিষ্ট্যের পরিধি বেড়েছে।
সোহাগ বলেন, বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে অটিজম নিয়ে সচেতনতা বহুগুণ বেড়েছে। আগের চাইতে অনেক বেশি অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুরা শনাক্ত হচ্ছে এবং সঠিক পরিচর্যা ও সেবা পাচ্ছে। কিন্তু এরপরও অটিজম নিয়ে রয়ে গেছে কিছু ভ্রান্ত ধারণা। সবার আগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ এবং উপদেশ মেনে নিতে হবে। এরপর বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পরিচর্যা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ আর প্রয়োজনে বিশেষ কিছু সমস্যার ওষুধ সেবন করতে হবে। অটিজম আছে এমন শিশুদের আচরণজনিত সমস্যা, অতিচঞ্চলতা, অস্থিরতা, নিজেকে আঘাত করার প্রবণতা, খিঁচুনি বা খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদির জন্য প্রথিবীর সব উন্নত দেশেই সীমিত আকারে ওষুধের প্রয়োগ রয়েছে। এই ওষুধ তাকে প্রশিক্ষণের উপযোগী করে তুলবে এবং সহযোগী সমস্যাকে কমাবে। তবে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খাওয়াতে হবে।
অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশুদের পরিচর্যার জন্য যে বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে তা হলো:
বাবা-মায়ের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, শিক্ষক, চিকিৎসক, থেরাপিস্টসহ সবাইকে সম্মিলিতভাবে পরিচর্যায় অংশ নেওয়া, কাঙ্খিত আচরণের জন্য শিশুকে উৎসাহিত করা, শুরুতে সাধারণ মূলধারার স্কুলে প্রেরণ, স্কুলের পাশাপাশি বাড়িতেও শিশুকে সামাজিক রীতিনীতি শেখানোর চেষ্টা, সামাজিক অনুষ্ঠানে শিশুর অংশগ্রহণ, শিশুর উৎসাহের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া, সেটির চর্চা করা (যেমন ছবি আঁকা, গান গাওয়া, খেলাধুলা ইত্যাদি), প্রয়োজনে বিশেষায়িত স্কুলের সাহায্য নেওয়া, ভাষার দক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা, প্রয়োজনে ইশারা ভাষা শেখানো ইত্যাদি।
বাসস-ইউনিসেফ ফিচার/ফই/০৯৪০/আহো/-স্বব