বাসস-ইউনিসেফ ফিচার-৪
ঝুঁকিপূর্ণ-শিশুশ্রম
শিশু শ্রমের প্রধান কারণ অভিভাবকদের অসচেতনতা
ঢাকা, ২৬ নভেম্বর, ২০২০ (বাসস/ইউনিসেফ) : রাজধানীতে কমলাপুরের একটি গ্যারেজে প্রায় তিন বছর ধরে কাজ করে সাগর (১২)। প্রথমে তাকে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ শিখতে হয়েছে। এখন মালিক তাকে দিনে ৮০ টাকা আর দুপুরে খাবার দেয়। কোনো ছুটি নেই। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যান্ত কাজ করতে হয়। রুবেল এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে, কারণ তার ঠেলাগাড়িচালক বাবার পক্ষে ৬ জনের পরিবারকে ভরণ-পোষণ করা সম্ভব নয়। তাই পরিবারের অভাব কিছুটা লাঘব করার জন্য বাবাকে সাহায্য করছে সে। কমলাপুর সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ওয়ান পর্যন্ত লেখাপড়ার পর বন্ধ হয়ে যায়।
শিশু শ্রমের প্রধান কারণ নিন্ম আয়ের পরিবারে অভিভাবকরা সচেতনতার অভাবে তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চান না। প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে শিশুদের পর্যাপ্ত সরকারি সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও অনেক বাবা-মা অসচেতনতার কারণে তার সন্তানকে স্কুলে না পাঠিয়ে অর্থ লাভের আশায় শিশু শ্রমে নিয়োজিত করেন। যা অত্যন্ত অমানবিক, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং শিশুর শিক্ষার পথে সবচেয়ে বড় বাধা। আবার লেখাপড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ঝড়ে পড়া শিশুরা বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হয়ে পড়ে।
দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ শিশু। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ অনুযায়ী, দেশে ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা প্রায় ৭৪ লাখ। এদের মধ্যে একটি বিরাট অংশ ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত।
‘বাংলাদেশে শিশুশ্রমের অবস্থান’ শীর্ষক এক সমীক্ষায় শিশুশ্রমের কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে- দারিদ্র্য, পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি না থাকা, বাবা-মা পরিতাজ্য, অসেচতনতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অভিবাসন ইত্যাদি।
জাতিসংঘ ১৯৫৯ সালে শিশু অধিকার সনদ ঘোষণা করে। বাংলাদেশ এই সনদে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। বাংলাদেশ শিশু আইন অনুযায়ী ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সবাইকে শিশু হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। শিশু অধিকার সনদে বলা হয়েছে, শিশুদের মৌলিক অধিকার যেমন- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে হবে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও’র) একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের শিশুরা অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, অ্যালুমিনিয়াম, আগরবাতি, বেলুন, ব্যাটারি, রি-রোলিং, আসবাবপত্র কারখানা, মোটর গ্যারেজ, গ্যাস বার্নার মেরামত, বই বাঁধাই, বৈদ্যুতিক কাজ, চামড়া কারখানা, গাড়ি ও ফার্নিচারে রং করা, বাতি তৈরি ও লেদ মেশিনে লোহা কাটার মত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ শিশুশ্রম নিরসনে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশে ইউনিসেফ, আইএলও এবং বিজিএমইএ পোশাক শিল্পে শিশুশ্রম নিরোধে ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা সনদ স্বাক্ষর করেছে। যেখানে গার্মেন্টস শিল্পে শিশুশ্রম বন্ধ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকারের কঠোর নজরদারীতে গার্মেন্টস সেক্টরে শিশুশ্রম বন্ধ হয়েছে।
শিক্ষা এবং কারিগরি দক্ষতা ছাড়া মানুষকে উচ্চ উৎপাদনশীল কাজ করতে পারে না। তাই সরকার সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার প্রসারে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সরকারি সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতিটি অভভাবকের প্রয়োজন তাদের শিশুদের স্কুলে পাঠানো। অল্প বয়সে শিশুকে কাজে না পাঠিয়ে তাকে শিক্ষিত করলে ভবিষ্যতে সে অনেক বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারবে।
আগামী ২০২১ সালের মধ্যে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চলেছি। তাই শিশুশ্রম প্রতিরোধে ১৮ বছর বয়সের নীচে কোন শিশু যেন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে না পারে তার জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন অভিভাবকদের সচেতনতা। প্রাথমিক স্তর থেকে শিশুদের ঝরে পড়া রোধ করতে হবে। শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। যেসব বাসা এবং কারখানায় শিশু শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত, তাদের মালিককে শিশুর প্রতি যতœশীল হতে হবে। তাদের কম কষ্টের এবং ঝুঁকিহীন কাজ করার পাশাপাশি শিক্ষার সুযোগ এবং স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
বাসস-ইউনিসেফ ফিচার/হাবিবুর/১১৩০/কেজিএ