বাসস ইউনিসেফ ফিচার-৩ : সিলেট বিভাগের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিশুরা এখনো মাত্রাতিরিক্ত অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভুগছে

108

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-৩
শিশু-অপুষ্টি
সিলেট বিভাগের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিশুরা এখনো মাত্রাতিরিক্ত অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভুগছে
ঢাকা, ২৬ নভেম্বর, ২০২০ (বাসস) : সাড়ে চার বছর বয়সী সায়মাকে তার মা আর নানী গত ৫ জুলাই ভর্তি করান সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার রাজানগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্্ের। সায়মার নানী বলেন, গত প্রায় ১৫ দিন ধরেই তার নাতনি তেমন কিছুই খাচ্ছে না। জোর করে কিছু খাওয়ালে বমি করে দেয়। এ ক’দিনেই মেয়েটা একেবারে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তাই তাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি।
হাসপাতালের ডিউটিরত ডাক্তার বলেন, সায়মা মূলত অপুষ্টিতে ভুগছে। তার ওজন মাত্র সাড়ে এগার কেজি। অথচ এ বয়সে তার ওজন ১৭ থেকে ১৮ কেজির বেশি হওয়ার কথা ছিল। আবার তার বয়স অনুপাতে উচ্চতাও কয়েক ইঞ্চি কম। এখন তাকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। আর পুষ্টিকর খাবারের তালিকা করে দিয়ে আগামী দুই দিন পর তাদের রিলিজ দেওয়া হবে।
সায়মার মত এ হাসপাতালে আরো তিনজন শিশু ভর্তি রয়েছে বলে জানান ওই ডাক্তার। তাদের সবার হেলথ কমপ্লিকেশনস প্রায় একই। সবাই অপুষ্টিতে ভুগছে।
তাদেরই একজন রসুল। পুরো নাম গোলাম মাঈন উদ্দিন রসুল। তার মা জোবেদা জানান, তার পাঁচ সন্তান। রসুল সবার ছোট। অন্য সব বাচ্চারা সুস্থ আছে। কিন্তু রসুল কিছুদিন পরপর অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর বছরের প্রায় সময়ই আমাকে হাসপাতালে কাটাতে হয়।
ওই সময় হাসপাতালে ভর্তি থাকা রাফিজার বাবা আনোয়ার বলেন, আমার মেয়েও অপুষ্টিতে ভুগছে। আবার তার উচ্চতাও কম। তবে এখন পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর পর থেকে তার ওজন প্রায় চার কেজি বেড়েছে গত সাড়ে সাত মাসে।
সূত্র মতে সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিশুরা এখনো মাত্রাতিরিক্ত অপুষ্টিজনিত খর্বতা (স্টান্টিং) নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। সেভ দ্য চিলড্রেনের পুষ্টি বিষয়ক কার্যক্রম ‘সূচনা’র মাঠকর্মীরা এসব শিশুদের শনাক্ত করে থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে খর্বকায় ও লম্বার তুলনায় কম ওজনের মানুষের সংখ্যা বেশি। অথচ জাতিসংঘ গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) পুষ্টির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এসডিজির ২ নং লক্ষ্য ক্ষুধা মুক্তি, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন এবং সব ধরনের অপুষ্টি দূর। এসডিজির লক্ষ্য অর্জনে তাই অপুষ্টি মোকাবিলার বিষয়টি গভীরভাবে আমলে নিতে হবে।
‘সূচনা’র ডেপুটি প্রোগ্রাম ডিরেক্টর মোহাম্মদ আলী রেজা বলেন, অপুষ্টির শিকার শিশুদের মায়েরা জানে না ‘স্টান্টিং’ কী এবং কেন হয়। তারা শিশুর প্রথম এক হাজার দিন সম্পর্কে সচেতন না। এমনকি গর্ভধারণ থেকে দুই বছর পর্যন্ত শিশুর সামগ্রিক বিকাশের জন্য পুষ্টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়েও তারা অসচেতন। প্রসঙ্গত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পুষ্টির অভাবে শিশুর বৃদ্ধি এবং বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হওয়াকে ‘স্টান্টিং’ বলা হয়।
২০১৩ সালে ইউনিসেফের একটি জরিপ অনুযায়ী, মায়েদের নিম্নশিক্ষার হার এবং সামাজিক ও আর্থিক সংকট শিশুর পুষ্টিহীনতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে (বিডিএইচএস) ২০১৪ অনুযায়ী, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে খর্বকায় হওয়ার হার ৩৬ শতাংশ। ২০১১ সালে এটি ছিল ৪১ শতাংশ, ২০০৭ সালে ৪৩ শতাংশ এবং ২০০৪ সালে ৫১ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিলেট বিভাগে খর্বাকায় শিশুর হার সবচেয়ে বেশি। যা ২০১৪ সালে ছিল ৪৯ দশমিক ৬ শতাংশ।
এ অঞ্চলের শিশুর অপুষ্টি ও খর্বকায় রোধে ‘সূচনা’ ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছয় বছর কাজ করবে। এ সময় ২ লাখ ২০ হাজার মানুষের অপুষ্টি রোধের পরিকল্পনা রয়েছে সংস্থাটির। গর্ভবতী মা ও কিশোরী এবং নবজাতককে পুষ্টি বিষয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা, দারিদ্র্যতা দূর এবং কিশোরীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে কাজ করছে তারা।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মনির হোসের বলেন, পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাবে শিশুর বিকাশ ব্যাহত হয়। মানসিক শক্তি কমে যায়। লেখাপড়ায় দুর্বলতা বাড়ে, অনেক সময় মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। শিশুর খর্বকায়ত্বের পেছনে মস্তিস্কের পুষ্টিহীনতা দায়ী বলে তিনি জানান।
সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. হিমাংশু লাল রায় বলেন, বাবা-মায়ের অজ্ঞতা এবং বাল্যবিয়ে অপুষ্টি ও খর্বকায় শিশুর মূল কারণ। এছাড়া সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কারতো রয়েছেই।
বাসস ইউনিসেফ ফিচার/সুঘো/১১২৫/স্বব