বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২ : নারীর ক্ষমতায়নে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে চরের সংগ্রামী আছিয়ারা

196

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২
চর-নারী-ক্ষমতায়ন
নারীর ক্ষমতায়নে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে চরের সংগ্রামী আছিয়ারা
ঢাকা, ২৬ নভেম্বর, ২০২০ (বাসস) : আছিয়া খাতুন। বয়স চল্লিশের কোটায়। বাড়ি কুড়িগ্রামের চিলমারী এলাকার ব্রহ্মপুত্রের চরে। স্বামী পরিত্যক্তা এই নারীর সম্পদ বলতে আছে বাড়ির পাশের চার শতক জমি। এই জমিতেই শুরু করেন জীবন বদলের সংগ্রাম। তাকে সহযোগিতা করেন মেয়ে ললিতা খাতুন আর ছেলে মো. সাইফুল ইসলাম।
বর্তমানে বছরের বিভিন্ন সময় এই জমিতে মরিচ, লাউসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি উৎপাদন করেন। নিজে খাওয়ার পর সেগুলো বিক্রি করেন। আয় দিয়ে অন্যের জমিতেও সবজি চাষ শুরু করেন আছিয়া। এখন তিনি স্বাবলম্বী। জীবন-সংগ্রামে অবতীর্ণ জয়ী হয়ে নিজেই নিজের ভাগ্যেও চাকা ঘুরিয়েছেন। ছেলেকে বিয়ে করিয়েছেন, মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। এখন তার সুখের সংসার।
শুধু আছিয়াই নন, এভাবে সংগ্রাম করে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন কুড়িগ্রাম জেলার ব্রহ্মপুত্র-তিস্তার চরের বিভিন্ন গ্রামের নারীরা। পঞ্চাশ বছর বয়সী আছিয়া বলেন, হামরা শুধু খাটুনি খাটি যাই। নদীর সাথত যুদ্ধ করি চলি। নদী এই ভাঙে এই গড়ে। দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে নিজের ভাগ্য ঘুরিয়েছি। এখন হাতেও ট্যাকা থাকে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই।
সরেজমিনে দেখা যায়, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের মিলনস্থলের এক বিশাল চর এলাকা নানাবিধ দুর্যোগের শিকার। বিশেষ করে বন্যা, নদী ভাঙন, শৈত্যপ্রবাহ. ঘূর্ণিঝড়, সঙ্গে রয়েছে খরা। ফলে, বছরের একটা সময় এ অঞ্চলে তীব্র খাদ্য সংকট বিরাজ করে। নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে এক ভঙ্গুর পরিবেশে বসবাসকারী বিপুলসংখ্যক মানুষ অতি দারিদ্র্যের কবলে পড়েন। এখানকার মানুষের অবস্থা বেশ নাজুক।
নারীর অবস্থা আরও শোচনীয়। পুরুষদের অনেকে দূরে চলে যান কাজের সন্ধানে। সন্তান ও বয়স্কদের খাওয়া-পরার দায়িত্ব নিতে হয় এই নারীদেরই। সামাজিক বন্ধনগুলোও আলগা হয়ে যায় এদের জন্যে। সামাজিকভাবে প্রান্তে ঠেলে দেওয়া এই মানুষগুলোর সন্তানেরা নানামাত্রিক শোষণের শিকার হয়। তাদের মেয়েদের কম বয়সেই বিয়ে দেওয়া হয়। কম বয়সে মা হতে গিয়ে অনেক নারীই প্রাণ হারায়।
তাছাড়া, অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সমস্যাও বেড়ে যায় তাদের। মানবাধিকার বঞ্চিত এসব মানুষকে সামাজিক সুরক্ষা দেবার জন্যে চরভিত্তিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা খুবই প্রয়োজন।
চিলমারীর একটি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য রহমতউল্লাহ বলেন, আমরা শুনেছি সরকার প্রতিবছর চরের মানুষের জন্যে বাজেটে বরাদ্দ দেয়। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাবে এই অর্থ খরচ করা যাচ্ছে না। আমরা এ বিষয়ে সরকারের কাছে একটা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গঠন করে সুষ্ঠুভাবে বাজেটের অর্থ ব্যয়ের দাবি করছি।
জানা যায়, অবকাঠামোসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত থাকা সত্ত্বেও প্রান্তিক মানুষগুলোকে নিজেদের পায়ে দাঁড় করাতে উদ্যোগী হয়েছে অনেক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন এদের অন্যতম।
২০০৫ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানটি এই চরাঞ্চলের ভূমিহীন কৃষক পরিবারের নারীদের সংগঠিত করে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহরের মাধ্যমে কুমড়া ও অন্য কিছু উচ্চফলনশীল ফসলের চাষে উদ্বুদ্ধ করেছে। প্রথমে গাইবান্ধার নীলকুঠি বাঁধের পাড়ের পরিবারগুলো নিয়ে শুরু হয়। ধীরে ধীরে বাদবাকি তিনটি জেলাতেও এই কর্মসূচি শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত ১৯ হাজারেরও বেশি পরিবারকে এই উদ্ভাবনমূলক নতুন প্রযুক্তির চাষে যুক্ত করেছে প্র্যাকটিক্যাল।
এসব ফসলের চাষের জন্য কারিগরি পরামর্শ, উপযুক্ত বীজ, সার, বাজারজাতকরণের বুদ্ধিসহ নানামাত্রিক পরামর্শ দেয় প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা। সুবিধা গ্রহণকারীদের ৯০ শতাংশই নারী। তাই, নারীর ক্ষমতায়নে এই প্রকল্প বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
ফসল চাষের প্রক্রিয়া বিষয়ে সংস্থাটির কর্মীরা জানান, চাষের জন্যে মাত্র ১৫০ দিনের মতো সময় পান নারী কৃষকরা। প্রথমেই স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনের সঙ্গে বসে জেগে ওঠা চরে কুমড়া, স্কোয়াশ, চেরি, টমেটো, চাইনিজ বাঁধাকপি, গাজর, বিটসহ নানা পণ্যের চাষের জন্যে জমি বরাদ্দ দেয়া হয়। এজন্য স্থানীয় নারীদের নিয়ে গঠন করা হয় সমিতি।
একেকটি সমিতির জন্যে একেকটি এলাকা চিহ্নিত করা হয়। প্রত্যেক সদস্যকে একটি করে লাইনে কুমড়া চাষের সুযোগ করে দেওয়া হয়। লাইন ধরে অসংখ্য পিট খোঁড়া হয়। ওই পিটে গোবর ও অন্যান্য আবর্জনা ঢেলে জৈব সার তৈরি করা হয়। প্রত্যেক সদস্যই গাভী পালেন এবং তাদের গাভীর গোবর দিয়েই এই পিট ভরা হয়।
সমিতির সদস্য আছিয়া বলেন, মাঠকর্মীদের পরামর্শ মতো আমরা পিটে মিষ্টি কুমড়ার নানা জাতের বীজ বপন করি। কয়েকটি লাইনের জন্যে বালু খুঁড়ে পলিথিন বিছিয়ে ছোট জলাশয়ে পুকুরে পানি মজুত করা হয়। প্রতিদিনই সদস্যরা এই জলাশয় থেকে পানি তুলে গাছের পিটে ঢালেন। এতে গাছ সতেজ থাকে।
গাছে মিষ্টি কুমড়া এলে এগুলোর রোগবালাই রোধে কারিগরি পরামর্শ প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশনের কর্মীরাই দিয়ে থাকেন বলে জানান তিনি।
বাজারজাত বিষয়ে স্থানীয় একজন যুবক বলেন, মাত্র তিন-চার মাসেই মাঠভর্তি মিষ্টি কুমড়া হয়। এগুলো প্রায় একবছর পর্যন্ত ঘরে রাখা যায়। এগুলো সহজে পচে না। তাই, এর চাহিদা ভালো। বাইরে থেকে ব্যবসায়ীরা এই এলাকা থেকে এসে ট্রাকে ট্রাকে মিষ্টি কুমড়া সংগ্রহ করছেন।
‘প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন’ কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে ‘পাম্পকিন্স এগেইন্সট পোভার্টি’ প্রকল্পের যাত্রা শুরু করে ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে। এর আগে জুলাই-আগস্ট মাসে প্রবল বন্যা হয়েছিল এই এলাকায়। অতিদরিদ্র মানুষেরা ঘরবাড়ি হারিয়ে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছিলেন। প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশন চিলমারীর বন্যার্তদের মাঝে রিলিফ বিতরণের সময় প্রায় ৭ মেট্রিক টন মিষ্টি কুমড়া বিতরণ করেছিল। এরপরই মূলত সংস্থাটি এই প্রকল্প চালু করে।
গতবছর ২৫টি স্পটে মোট ২ হাজার ১০১ জন চাষি (৯০ শতাংশ নারী) ২১০ হেক্টর বালু চরে ৬ হাজার ৫৭৫ মেট্রিক টন মিষ্টি কুমড়া উৎপাদন করেন। এর স্থানীয় বাজার মূল্য (৮ টাকা কেজি দরে) ছিল ৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা।
‘প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশনে’র কর্মকর্তা সাইদুল ইসলাম জানান, প্রকল্পের পক্ষ থেকে তাদের কুমড়া সংরক্ষণের জন্য প্রাকৃতিক মাচা তৈরি ও বাজারজাতকরণে সহায়তা দেওয়া হয়।
জানা যায়, গতবছরে কুড়িগ্রাম জেলায় ৭৪০টি বালুচরে ৫ হাজার সদস্য-সদস্যা ২৭ হাজার মেট্রিক টনের মতো মিষ্টি কুমড়া উৎপাদন করেন। পূর্ণ মৌসুমে যখন সবুজ ও লাল রঙের নানা মাপের মিষ্টি কুমড়া নিয়ে তারা বাড়ি ফেরেন তখন তাদের সব কষ্ট দূর হয়ে যায়।
জয়ন্তী রানী রায় নামে এক কৃষক বললেন, গেল বছর তার আয় হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার টাকা। গাভী পালন ও মিষ্টি কুমড়া চাষ করে নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য বদলে ফেলেছেন তারা।
কুড়িগ্রামের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান প্রধান জানান, নতুন পদ্ধতিতে মিষ্টি কুমড়াসহ নানা ধরনের সবজি চাষ করে চরে নারীরা কৃষি বিপ্লব সংগঠিত করেছেন। এতে পরিবার ও সমাজে তাদের অবস্থান আরও দৃঢ় হচ্ছে।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/মাআ/০৯৪৫/আরজি