বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড, মোশতাককে প্রথম চ্যালেঞ্জ করেন সিরাজুল হক

1607

॥ আনিসুর রহমান ও তানজিম আনোয়ার ॥
ঢাকা, ২৭ অক্টোবর, ২০২০ (বাসস ডেস্ক): বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রের মূল হোতা খন্দকার মোশতাক আহমেদ ১৫ আগস্ট নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পরপরই নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্ত দুই মাস পর্যন্ত যতক্ষণ না কেউ একজন এসে সরাসরি এর প্রতিবাদ করেছিলেন ততক্ষণ দৃশ্যত তিনি চ্যালেঞ্জবিহীনই ছিলেন।
ইতিহাস সাক্ষী দেয় সেই ব্যক্তিটি ছিলেন সিরাজুল হক। তিনি ছিলেন তৎকালীন সিনিয়র আইনপ্রণেতা এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাল্যবন্ধু।
একজন খ্যাতিমান ফৌজদারী আইনজীবী হিসেবে তিনি অবশেষে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার মামলায় প্রধান প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। ঘটনাচক্রে এবছর এই খ্যাতিমান আইনপ্রণেতার ১৮ তম মৃত্যু বার্ষিকী।
কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত সংসদ হিসেবে বঙ্গভবনে এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আলী আশরাফ বাসসকে বলেন ‘চোখে চোখ রেখে করা এই প্রতিবাদ ছিল খুবই স্পষ্ট ও জোরালো।’
আলী আশরাফ এখনও পার্লামেন্টের একজন সদস্য। তিনি সেদিনের সেই সিরাজুল হকের তীব্র প্রতিবাদ জানানোর ঘটনা স্মরণ করে বলেন, সিরাজুল হক যখন অগ্মিশর্মা হয়ে মোশতাকের চোখে চোখ রেখে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন তখন খুনিরা সামরিক পোশাকে চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তাদের দৃঢ় উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল এবং বন্দুক নাড়াচাড়া করছিল। ঘটনাস্থলের সকলেই তখন ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়েছিল।
তবে, তিনি সেদিনের তারিখটি নির্দিষ্ট করে বলতে না পারলেও ধারণা করছেন এটি ছিল অক্টোবরের মাঝামাঝি কোন একদিন। ওইদিন বঙ্গভবনে মোশতাকের সঙ্গে সিরাজুল হকের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের মধ্যদিয়ে বৈঠকটি আকস্মিকভাবে শেষ হয়ে যায়।
সিরাজুল হকের পুত্র বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, মোশতাক মূলত অক্টোবরে দুটি বৈঠক ডেকেছিলেন। একটি অক্টোবরের মাঝামাঝি এবং দ্বিতীয়টি একই মাসের শেষের দিকে।
তিনি আরো জানান, প্রথম বৈঠকে সারাদেশের আইনপ্রণেতাদের ডাকা হয় এবং দ্বিতীয়টিতে কেবলমাত্র কুমিল্লার এমপিদের ডাকা হয়। কুমিল্লা মোশতাকের নিজ জেলা।
তবে, জুনিয়র হক বৈঠকের নির্দিষ্ট দিনক্ষণটি সঠিকভাবে বলতে না পারলেও এটি নিশ্চিত করেছেন যে উভয় বৈঠক থেকে ফিরে তার বাবা তাকে ওই দুই দিন বঙ্গভবনে যা যা ঘটেছিল তা বিস্তারিতভাবে জানিয়েছিলেন।
মোশতাক মূলত এসব বৈঠক ডেকেছিলেন বন্দুকের জোরে আইন প্রণেতাদের আনুগত্য আদায়ের চেষ্টা করতে। কিন্তু ওই দুই বৈঠকেই সিরাজুল হক তার রাষ্ট্রপতিত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন।
আনিসুল হক আরো বলেন, ওই দুই বৈঠকে তার বাবা খন্দকার মোশতাক আহমেদকে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বৈঠকে খুবই উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয় এবং তুলনামূলকভাবে এটি একটি ছোট সমাবেশ ছিল। যারা আইনজীবী সিরাজুল হককে সমর্থন জানানোর চেষ্টা করেছিলেন খন্দকার মোশতাক তাদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন।
আনিসুল হক তার বাবার কাছ থেকে যা শুনেছিলেন তার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন।
প্রথম বৈঠকে সিরাজুল হক যা বলেছিলেন তা উদ্ধৃত করে তিনি বাসসকে বলেন, ‘আজ আমি আপনাকে রাষ্ট্রপতি ডাকতে পারছি না। আমি আপনাকে মোশতাক ভাই বলতে পারি। কিন্তু আমি যে খন্দকার মোশতাককে জানতাম আপনি এখন আর সেই মোশতাক নন বলে আমি আপনাকে মোশতাক ভাইও ডাকতে পারছি না। তাই, আপনাকে আমি কিছুই ডাকছি না।
আনিসুল হক বলেন, তার বাবা মোশতাককে স্মরণ করিয়ে দেন, বঙ্গবন্ধু ও তার উভয়ের সঙ্গে মোশতাকের ২৭ বছরের ঘনিষ্ঠতার কথা, যখন তারা এমনকি এক থালার খাবারও ভাগাভাগি করে খেয়েছেন তখন তিনি (মোশতাক) কখনই বঙ্গবন্ধুর কোন সিদ্ধান্তের সমালোচনা কিংবা কোন অভিযোগ করেননি।
জুনিয়র হক বলেন, আর আজ আপনি বলছেন বঙ্গবন্ধু চোর, আপনি ভালো মানুষ , আমি তা চেয়ে চেয়ে দেখব? আপনি বলছেন আমাকে তা দেখতে? কতো বড় সাহস আপনার।
ওই সময়ে ঘটনাস্থলে অভ্যুত্থানকারীদের একজন সিরাজুল হককে লক্ষ্য করে বন্দুক তাক করলে তাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘মেজর, আমি আপনার সঙ্গে কথা বলছি না। আমি তার (মোশতাকের) সঙ্গে কথা বলছি। কারণ, তিনি আমাদেরই একজন ছিলেন। আপনি আমাকে হত্যা করতে চাইলে পাঁচ মিনিট পরে করুন। আমি যা বলতে চাচ্ছি তা আমাকে শেষ করতে দিন।’
সিনিয়র অন্যান্য আইনপ্রণেতা যাদের মোশতাকের তৈরি লিস্ট ধরে কথা বলার জন্য ডাকা হচ্ছিল তারা মোশতাক ও অভ্যুত্থান নেতাদের রোষ থেকে বাঁচতে সতর্কতার সঙ্গে কথা বলছিলেন।
অনেক বছর পরে খ্যাতিমান সাংবাদিক মরহুম এবিএম মুসা যিনি একজন আইনপ্রণেতা হিসেবে বঙ্গভবনে ওই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তিনি তার স্মৃতিকথায় সেদিনের ঘটনা স্মরণ করেন এভাবে সিরাজুল হকের কথায় সেদিন ঘটনাস্থলে দু’জন মেজর উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। পরে মোশতাকের ইশারায় তারা কামরা থেকে বেরিয়ে যান।
মুসা আরো লেখেন, এরপর সিরাজুল হক সরাসরি প্রশ্ন করেন, আপনি কেন মুজিবকে হত্যা করেছেন?
মোশতাকের জবাব ছিল, এই হত্যাকান্ডের প্রয়োজনীয়তা কি ছিল তা জনগণ যথাসময়ে উপলদ্ধি করতে পারবে।
মুসা আরো বলেন, সিরাজুল হক তখন বলেছিলেন প্রয়োজনীয়তাটা কি ছিল তা জানতে আমি অপেক্ষা করবো। তা না জানা পর্যন্ত আমরা আপনাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারি না।
আনিসুল হক বলেন, দ্বিতীয় বৈঠকে উত্তেজনা তীব্র রূপ নেয়। ওই বৈঠকে মোশতাক বিশেষভাবে তার নিজ জেলার এমপিদের ডেকেছিলেন।
বাসসের সাথে পৃথকভাবে কথা বলতে গিয়ে আশরাফ তার স্মৃতি হাতড়িয়ে জুনিয়র হককে সমর্থন করে বলেন, ধূর্ত স্বভাব সত্ত্বেও সমালোচিত মোশতাক সেদিন তার শীতল মেজাজ ধরে রাখতে ব্যর্থ হওয়ায় রক্তপাতের আশংকায় দ্বিতীয় বৈঠকে যোগ দেয়া আইনপ্রণেতারা কার্যত পালিয়ে যান।
আনিসুল হক ও আশরাফ উভয়ের মতে, মোশতাক প্রথমে স্থানীয় রাজনীতিতে তার প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচিত কুমিল্লার সিনিয়র আইনপ্রণেতা কাজী জহিরুল কাইয়ুমকে এক হাত নেন। এরপর তিনি সিরাজুল হককে ধরেন।
কাইয়ুম কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলার চেষ্টা করেন, তিনি মোশতাকের বিরুদ্ধে কিছুই বলেননি।
‘এরপর মোশতাক আমার বাবা সম্পর্কে কথা বলতে শুরু করেন এবং বলেন, আমি হয়তো কোন ভুল করেছি..কিন্তু কেন এই লোক (সিরাজুল হক) আমার বিরুদ্ধে তীব্র প্রচারণা চালাচ্ছে। একজন আইনজীবী হিসেবে তার মূল্য কতো!’ এ কথা উল্লেখ করেন আনিসুল হক।
তিনি বলেন, সিরাজুল হক তাকে জানিয়েছেন প্রথমে তিনি চুপচাপ থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মোশতাক ধীরে ধীরে দুজন আইনপ্রণেতাকে তীব্র অবমাননা করতে থাকেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন নারী যিনি তার পিতাকে সমর্থনের চেষ্টা করছিলেন।
জুনিয়র হক বলেন, কুমিল্লার বাঞ্ছারামপুর আসনের আইনপ্রণেতা ড. আবদুল হক প্রথমে ভদ্রভাবে সিরাজুল হকের পক্ষে বলার চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি মোশতাকের তীব্র তীরস্কারের মুখে পড়েন।
এরপর প্রফেসর মমতাজ বেগম যিনি সংরক্ষিত নারী আসন থেকে এমপি হয়েছিলেন তিনি সিরাজুল হকের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিলে মোশতাক তাকে বিশ্রি ভাষায় গালিগালাজ করে থামিয়ে দেন।
মমতাজ বেগম সিরাজুল হককে চাচা বলে সম্বোধন করতেন। দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর তিন মাস আগে তিনি মারা যান।
জুনিয়র হক বলেন, তাদেরকে অবমাননা করতে দেখে আমার বাবা উঠে দাঁড়ান এবং বলেন, যথেষ্ট হয়েছে। আপনি (মোশতাক) সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে কথা বলছেন। আপনি বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে রাস্তায় আসুন। আমি আপনার গালে চড় মারব।
তিনি বলেন, তিনি তার পিতা ও ঘটনাস্থলে থাকা অন্যান্যদের কাছ থেকে জেনেছেন সিরাজুল হকের মন্তব্যের পরই হৈ হট্টগোল বেঁধে যায় এবং কার্যত প্রত্যেকে পালিয়ে যাওয়ায় বৈঠকও শেষ হয়ে যায়।
আশরাফ বলেন, তিনিও সিরাজুল হকের সাথে বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন এবং স্মরণ করেন সিনিয়র ওই আইনপ্রণেতা তাকে সাথে নিয়ে তার ব্যক্তিগত ভক্সওয়াগন গাড়ি নিজে চালিয়ে বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন।
বর্তমান আইনপ্রণেতা এবং সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার আশরাফ আরো বলেন, ওই দিনের বৈঠকের স্থান ছিল বঙ্গভবনের দরবার হল। কিন্তু অস্ত্রে সজ্জিত সামরিক লোকজন চারপাশ ঘিরে থাকায় দরবার হলকে মনে হচ্ছিল অবরুদ্ধ কোন কম্পার্টমেন্ট।
তিনি বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল বিধায় তিনি ভয় পাচিছলেন খুনীরা হয়তো গোলাগুলি শুরু করবে। তিনি বলেন, আমি সিরাজুল হকের বাহু আঁকড়ে ধরে বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসি কারণ তখন সকলেই পালাচ্ছিল।
আশরাফ বলেন, পরিস্থিতি আমাকে খুবই ঘাবড়ে দেয়। আমি ভয় পাচ্ছিলাম- খুনীরা হয়তো সিরজুল হকের পিছু নেবে। আমি তার গাড়িতে আর না চড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তাই, তাকে বলেছিলাম, আমি হেঁটেই যেতে পারব।
আনিসুল হক বলেন, ওই রাতে বাড়ি ফিরে তার বাবা তাকে বলেছিলেন, ‘বঙ্গভবনে আমি যা বলেছি, ঠিকই বলেছি। আমি পরিণামের পরোয়া করি না।’