প্রকৃতির ভারসাম্যে ও অর্থনীতিতে তালগাছের অবদান রয়েছে

215

বরগুনা, ৩ আগস্ট, ২০১৮ (বাসস) : ফল হিসেবে তাল বাংলাদেশে খুব একটা প্রচলিত ও জনপ্রিয় না হলেও গ্রামীণ অর্থনীতিতে, বজ্রপাতের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে, ভূমি ক্ষয়রোধক হিসেবে, গাছ থেকে আহরিত নানা দ্রব্য কয়েক স্তরে মূল্য সংযোজনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তালের রয়েছে নানা ঔষধি গুণাগুণ। অন্য ফলের তুলনায় এ ফলে ক্যালসিয়াম, লৌহ, আঁশ ও ক্যালোরির উপস্থিতিও অনেক বেশি।
গ্রীষ্মে কঁচি অবস্থায় তালের শাঁসের ব্যাপক চাহিদা থাকে গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত। প্রতিটি তালে ২ থেকে ৩টি শাঁস হয়। ভাদ্র মাসে তাল পাকলে আবার অন্যরকম স্বাদের ফলে পরিণত হয়। সাধারণত এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত পুরুষ বা স্ত্রী উভয় প্রকার একেকটি তাল গাছ থেকে ৭শ’ থেকে ১৫শ’ লিটার রস সংগ্রহ সম্ভব। তালের রসে, গুড়, চিনি, মিশ্রি, পিঠা বা ওয়াইন তৈরি হয়। পাকা তালের রস নিংড়িয়ে নেয়ার পর শক্ত আঠি ছাই বা মাটির মধ্যে ফেলে রাখলেই তা থেকে গজ বা শিকড় বের হলে সেগুলো কেটে সুস্বাদু ফোঁফরা (শাঁস) খাওয়া যায় এবং তা দিয়ে মোরব্বা তৈরি করা হয়।
একসময় কাগজের বিকল্প হিসেবে লেখার জন্য টোল বা পাঠশালায় তালপাতার ব্যবহার ছিল। এখন অবশ্য তালপাতা হাতপাখা ও ঘরে ছাউনি বা বেড়ার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। ঘরের পাটাতনের প্রয়োজনীয় ‘আড়া’র জন্য তালগাছ সবচেয়ে বেশি চাহিদা সম্পন্ন কাঠ বলে বিবেচিত। বরগুনার পাথরঘাটার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আবদুল হাকিম জানিয়েছেন, গ্রামীণ আবাসন তৈরিতে মূল্যবান কাঠ হিসেবে তালগাছের ব্যবহার দীর্ঘকালের। ৩০-৩৫ বছর বয়সের একটি তাল গাছের মূল্য ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
মৌসুমে তাল বিক্রি করে গ্রামের কৃষক পরিবার বাড়তি টাকা রোজগার করতে পারে। বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার গোলবুনিয়া গ্রামের কৃষক আশিষ তালুকদার জানিয়েছেন, বাড়ির পুকুর পাড়ে অযতœ অবহেলায় বেড়ে ওঠা ৫টি তাল গাছের কচি তাল পাইকারি দরে প্রতিটি এক টাকায় বিক্রি করে এ বছর ৩ হাজার টাকা পেয়েছেন। হাত বদল হয়ে বরিশাল বা ঢাকায় পৌঁছে প্রতিটি তালের (তিন শাসঁ) মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১৫ টাকা।
দক্ষিণ চরদুয়ানীর আবদুল করিম জানিয়েছেন, তিনি প্রতি বছর তালের রস থেকে গুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে ২০-২৫ হাজার টাকা আয় করেন।
ঢাকার শ্যামবাজারের আড়তদার মো. আজাদ মিয়া জানান, মৌসুমে প্রতিদিন উপকূল এলাকা থেকে কাওরান বাজার, সোয়ারি ঘাট, যাত্রাবাড়ি সহ বিভিন্ন স্থানে ২০ থেকে ২৫ হাজার ছড়া (প্রতিটিতে ২০/২৫টি তাল) তাল বিক্রির জন্য আসে। সে সময়ে ঢাকায় তালের শাঁস বিক্রি থেকে প্রতিদিন ৫০ লাখ টাকার লেনদেন হয়।
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েরর কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. বদিউজ্জামানের মতে, গ্রামীণ অর্থনীতিতে তাল গাছের অবদান রয়েছে। এটি টেকসই, লবণ সহিষ্ণু। ভূমিক্ষয় ও ঝড়-বাদল প্রতিরোধক একটি গুচ্ছমূল প্রজাতির গাছ। ধান বা পাট খেতের আ’লে, উপকূলের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে, কাঁচা-পাকা রাস্তোর দু’পাশে তাল গাছের বাগান করা যায়।
একই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনুষদের ইমারজেন্সি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. সামসুজ্জোহা জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাম্প্রতিক দুর্যোগ, বজ্রপাত বেড়ে গেছে। আমাদের লোকায়ত জ্ঞানই বলে উঁচু তাল গাছ বজ্রপাতের সময়ে নিজে বিদ্যুত গ্রহণ করে মানুষ সহ প্রাণীদের রক্ষা করে। তালগাছ দৃঢ় বলে ঝড়-ঝঞ্চায় আমাদের রক্ষা করে।
বরগুনার জেলা প্রশাসক মো. মোখলেসুর রহমান জানিয়েছেন, সরকারের উদ্যোগে সারা দেশে তাল বীজ বপণ করা হচ্ছে। সে ধারাবাহিকতায় এ বছর বরগুনা জেলার ৬টি উপজেলার বিভিন্ন সড়ক, পুকুর পাড় ও খালের পাড়ে তাল গাছের ৬ লাখ বীজ বপণ চলছে।