বাসস দেশ-২৩
চা-অর্থনীতি-উত্তরাঞ্চল
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অর্থনৈতিক পরিবর্তনে উদীয়মান খাত চা
॥ মামুন ইসলাম ॥
রংপুর, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ (বাসস) : বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় পাঁচটি জেলার সমন্বয়ে গঠিত ‘করতোয়া ভ্যালি’ অর্থনৈতিক অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষের জীবন-যাত্রার মান উন্নয়নে অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তনের মাধ্যমে উদীয়মান চা খাত কার্যকরী ভূমিকা রাখছে।
পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের বাংলাদেশ চা বোর্ডের (বিটিবি) কর্মকর্তারা জানান, ভ্যালিতে চলমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে ‘ক্ষুদ্র পরিসরে উদ্যান ভিত্তিক’ চা চাষ সম্প্রসারণ অব্যাহত রয়েছে।
পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলার সমন্বয়ে গঠিত ভ্যালিতে চলতি বছর চা উৎপাদন এক কোটি কেজির লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। গত বছরও চা উৎপাদন রেকর্ড পরিমাণ ৯৬ লাখ ৯৯ হাজার কেজি ছিল।
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার ড. মোহাম্মদ শামিম আল মামুন চা চাষ সূত্রপাতের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, ‘করতোয়া ভ্যালিতে’ এর উৎপাদন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঞ্চগড় সফরকালে জেলা প্রশাসক রবিউল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পঞ্চগড়ে পরীক্ষামূলকভাবে চা চারা রোপণ করেন।’ বিটিবির সায়েন্টিস্টরা ১৯৯৯ সাল থেকে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ে চা চাষের সম্ভাব্যতা নিয়ে ভালো ফলাফলের জন্য গবেষণা চালিয়েছেন এবং বাণিজ্যিকভাবে চা চাষের জন্য ১৬ হাজার হেক্টর জমি খুঁজে পেয়েছেন। শামিম বলেন, ‘২০০০ সাল থেকে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় তেঁতুলিয়া চা কোম্পানি লি. (টিটিসিএল) বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু করে।’ টিটিসিএলের সাফল্য কৃষিক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এরপর স্থানীয় কৃষকরা ভ্যালিতে ‘ক্ষুদ্র পরিসরে উদ্যান ভিত্তিক’ চা চাষ শুরু করে। তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ৯ জন নিবন্ধিত, ১৯ জন অনিবন্ধিত ও ৬,৫৫৮ জন ক্ষুদ্র মালিকানায় চা চাষের আওতায় ভ্যালিতে ৮ হাজার ৬৮০ একর জমিতে চা চাষ করে ৪ কোটি ৬৯ লাখ কেজি গ্রীন টি পাতা উৎপাদন করেন।
২০১৯ সালে উৎপাদিত গ্রীন টি পাতা ১৮ চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করে ৯৫ লাখ ৯৯ হাজার কেজি প্রক্রিয়াকৃত চা পাওয়া যায়। চলতি বছর প্রক্রিয়াকৃত চা এক কোটি কেজির লক্ষ্যমাত্রা ছাড়াতে পারে।
২০১৫ সালে বিটিবি ‘এক্সপ্যানসন অব স্মল হোল্ডিং টি কাল্টিভেশন ইন নর্দান বাংলাদেশ প্রজেক্ট’ এর মাধ্যমে ৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা ব্যয়ে চা চাষ শুরু করে। উদ্দেশ্য ছিল ২০২০ সালের মধ্যে ভ্যালিতে ৫ শতাধিক হেক্টর জমিকে চা চাষের আওতায় নিয়ে আসা।
শামিম আরো বলেন, ‘ক্ষুদ্র-পরিসরে উদ্যান ভিত্তিক’ চা চাষ সম্প্রসারণ অব্যাহত রয়েছে এবং সেইসঙ্গে প্রতিবছর হাজার হাজার চা শ্রমিকের কর্মসংস্থান বাড়ছে বিশেষ করে নারীদের।’
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র চা বাগান মালিক সমিতির সভাপতি আমিরুল হক খোকন আজ বাসসকে জানান, ক্ষুদ্র পরিসরে চা উদ্যান ভিত্তিক চা চাষ স্থানীয় কৃষকদের ভাগ্য পরিবর্তনের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘ভ্যালিতে চা চাষ বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে এবং এতে ১৫ হাজার নারীসহ ২৫ হাজার কর্মহীন মানুষ চা-পাতা প্যাকেটজাতকরণসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করছে।’ ১০ থেকে ২০ জন নারী-পুরুষ একত্রে গ্রুপ করে প্রতিদিন সবুজ চা পাতা প্যাকেটজাতকরণের মাধ্যমে তারা পাঁচশ’ থেকে ছয়শ’ টাকা আয় করছে। ‘দারিদ্র্যতার কারণে ১২ বছর আগেও গ্রামীণ নারীরা কঠিন সময় পার করছিলেন। এখন তারা দারিদ্র্যতা থেকে বেরিয়ে এসে সন্তানদের উজ্জল ভবিষতের স্বপ্ন দেখছেন।’
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বুড়াবুড়ি গ্রামের চা উৎপাদনকারী শাহিনুর রহমান বলেন, তিনি ২০১৬ সাল থেকে তার সমতল জমিতে ‘ক্ষুদ্র-পরিসরে উদ্যান ভিত্তিক’ চা চাষ শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘আমি ৫ দশমিক ৫০ একর জমিতে চা চাষ করেছি এবং চা প্রক্রিয়াজাত কোম্পানির কাছে আমার সবুজ চা পাতা প্রতি কেজি ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি করি।’
জেলার সদর উপজেলার গোয়ালপাড়া গ্রামের ক্ষুদ্র চা উৎপাদনকারী আব্দুল মালেক বলেন, তিনি এক বিঘা জমিতে চা চাষ করে প্রতি কেজি ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি করে থাকেন।’
এভাবে তেঁতুলিয়া উপজেলার চা উৎপাদনকারী আবু সাইদ, ফিরোজ আহমেদ, আব্দুস সুবহান, আলিয়ার রহমান ও আজিজুল হক ও সদর উপজেলার আবু তালেব, গিয়াস উদ্দীন ও মো. লিটন তাদের এক থেকে পাঁচ একর জমিতে চা চাষ করছেন।
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বুড়াবুড়ি গ্রামের চা শ্রমিক নাসিমা (৪০), সেলিনা হেমব্রন (৪০), গোকুল হাসদা (২৮), খাদিজা (২৫), আলেয়া (২৭) ও কল্পনা চা পাতা প্যাকেট করে প্রতিদিন পাঁচশ থেকে ছয়শ’ টাকা উপার্জন করছেন।
বাসস/এমআই/অনু-এএএ/১৮৩৪/কেএমকে