দেশে যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগ বাড়াতে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে

315

ঢাকা, ১৯ আগস্ট,২০২০ (বাসস) : বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগ আকর্ষন ও দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্প্রসারণে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণে সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এইসাথে তারা ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় হ্রাস ও কর ব্যবস্থা আরো সহজীকরণের প্রস্তাব দেন।
বুধবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘যুক্তরাজ্যের সাথে বাণিজ্য এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের সম্ভাবনা’ বিষয়ক এক ওয়েবিনার সেমিনারে ব্যবসায়ীরা এসব দাবি জানান।
অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম প্রধান অতিথি ছিলেন। ডিসিসিআই সভাপতি শামস মাহমুদের সভাপতিত্বে সেমিনারে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রাবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসন এবং যুক্তারাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সানেম’র নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। এতে অন্যান্যের মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এফটিএ) শরীফা খান, বিল্ড চেয়ারম্যান আবুল কাসেম খান, ডিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসেন খালেদ, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহীম, বেসিস সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির, ইনস্পেটা ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মোক্তাদির,প্রাণ আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইও আহসান খান চৌধুরী এবং রহিম আফরোজ স্টোরেজ পাওয়ার বিজনেসের নির্বাহী পরিচালক ফারাজ এ রহিম আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন,ব্রেক্সিট পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ২০২৭ সাল পর্যন্ত বৃটেনে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা নিয়ে পণ্য রপ্তানি করতে পারবে, যা আমাদের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত আশা ব্যঞ্জক একটি বিষয়। তিনি দু’দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ক ডায়ালগ আয়োজন, দু’দেশের বাণিজ্য সংগঠনসমূহের মধ্যে যোগাযোগ আরো সুদৃঢ়করন, কোভিড উত্তর বাণিজ্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় ‘মার্কেট স্ট্রাটেজি’ প্রণয়ন এবং বৃটিশ-বাংলাদেশীদের আরো বেশি হারে বাংলাদেশে বিনিয়োগে উৎসাহী করার প্রস্তাব করেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ তরুণ জনগোষ্ঠী তথ্য-প্রযুক্তি খাতে বেশ সম্ভাবনাময় এবং এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বৃটিশ তথ্য-প্রযুক্তি ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানসমূহ বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারে, যা তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, পাশাপাশি আমাদের তরুণদের দক্ষতাও বাড়াবে।
স্বাগত বক্তব্যে ডিসিসিআই সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগকারী দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্যের অবস্থান দ্বিতীয়, যেখানে গত মার্চ মাস পর্যন্ত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক প্রতিষ্ঠাসমূহ বাংলাদেশে ২ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ করেছে এবং প্রায় ২০০ বৃটিশ প্রতিষ্ঠানের এ দেশে বিনিয়োগ আছে। তিনি জানান, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন মূল্যের পণ্য যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করে, যেখানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের এর পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার। বৃটিশ বিনিয়োগ আকর্ষনে তিনি নতুন পণ্যের উদ্ভাবন এবং পণ্যের বহুমুখীকরণে উপর জোরারোপ করেন।
ডিসিসিআই সভাপতি বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগ আকর্ষন ও বাণিজ্য সম্প্রসারণে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করে সরকারকে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণের আহবান জানান। তিনি অবকাঠমোখাতে বৃহৎ প্রকল্পসমূহে যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগ আকর্ষনে ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার বন্ড’ চালুর প্রস্তাব করেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিকে চলমান রাখা,কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি এবং কোডিভ পরবর্তী অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী পণ্যের রপ্তানিতে শুল্ক ও কোটা মুক্ত সুবিধা আরো দীর্ঘ সময়ের জন্য বলবদ রাখা একান্ত প্রয়োজন বলে, শামস মাহমুদ মত প্রকাশ করেন।
যুক্তারাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম বলেন,বৃটিশ বাণিজ্য সংগঠনসমূহ বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য খাত বিষয়ে খুব বেশি অবগত নয় এবং এ অবস্থা উত্তরণে বাংলাদেশের চেম্বার ও এসোসিয়েশনগুলোকে যোগাযোগ আরো বৃদ্ধি করতে হবে। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যে প্রায় ৬০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ই-কমার্স বাজার রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশি তথ্য-প্রযুক্তি ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারে। হাইকমিশনার বলেন, বৃটেনে হালাল পণ্য এবং লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে বিশাল বাজার রয়েছে এবং বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা সহজেই এ সুযোগ গ্রহণ করে আরো বেশি হারে পণ্য যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করতে পারে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রাবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসন বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ একান্ত আবশ্যক।তিনি জানান, বাংলাদেশের ঔষধ, তথ্য-প্রযুক্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেবা এবং আর্থিক খাতসমূহে বৃটিশ বিনিয়োগ আকর্ষনে যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এছাড়াও তিনি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষনে বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় হ্রাস, প্রয়োজনীয় নীতিমালার সংষ্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। হাইকমিশনার বলেন, সম্প্রতি বৃটেনে ‘বাংলা বন্ড’ চালু হয়েছে, যা দুদেশের উদ্যোক্তাদের আতœবিশ^াস ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তিনি দুদেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণে বাংলাদেশস্থ বৃটিশ হাইকমিশন হতে সর্বাতœক সহযোগিতার আশ^াস দেন।
প্রাণ আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং সিইও আহসান খান চৌধুরী বৃটেনে বাংলাদেশী পণ্য ও সেবা রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণে দু’দেশের মধ্যকার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষর ও লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে প্রবর্তিত ‘বাংলা বন্ড’-এ বিনিয়োগ করার প্রস্তাব করেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এফটিএ) শরীফা খান জানান, বৃটিশ সরকার ২০২৭ পর্যন্ত বাংলাদেশী পণ্যের শুল্ক ও কোটা মুক্ত সুবিধা প্রদান করছে এবং বাংলাদেশী পণ্য রপ্তানিতে বিদ্যমান শুল্ক কাঠামোর বিষয়টি আলোচনাধীন রয়েছে।
ইনস্পেটা ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান আব্দুল মোক্তাদির জানান, যুক্তরাজ্যে প্রায় ৪ থেকে বিলিয়ন বৃটিশ পাউন্ডের জেনেরিক বাজার রয়েছে, যা আমাদের ফার্মাসিউটিক্যাল খাতের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। এছাড়াও তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বিজ্ঞান বিষয়ে বাংলাদেশের মানব সম্পদের দক্ষতা উন্নয়নে বৃটিশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের শাখা ক্যাম্পাস বাংলাদেশে খোলার প্রস্তাব করেন।
বেসিস সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর বলেন, সফটওয়্যার এবং তথ্য-প্রযুক্তি সেবাখাতে গতবছর বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১ বিলিয়ন ডলার এবং এ খাতে পণ্য রপ্তানিতে যুক্তরাজ্যর অবস্থান দ্বিতীয়। তিনি ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট তৈরিতে নিয়োজিত যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠানগুলোকে হাইটেক পার্কে বিনিয়োগের আহ্বান জানান, যার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা বিনিময় বৃদ্ধি পাবে।
আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসেন খালেদ তিনি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ সম্প্রসারণে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় হ্রাস এবং ভ্যালু চেইন স্থাপনের প্রস্তাব করেন।
আসিফ ইব্রাহীম বলেন,শীঘ্রই বাংলাদেশের দুটো পুঁজিবাজারই অটোমেশন কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসা হবে। তিনি বৃটিশ কোম্পানীগুলোকে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের আহ্বান জানান।
মূল প্রবন্ধে ড. সেলিম রায়হান বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগ আরো বৃদ্ধিতে বাংলাদেশী রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ, যথাযথ নীতিমালা ও কৌশল প্রণয়ন, ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় হ্রাস, দ্রুততম সময়ে অবকাঠামো এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) গুলোর কার্যক্রম বাস্তবায়ন, খুবই জরুরী বলে মত প্রকাশ করেন।