১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞের ষড়যন্ত্র উদঘাটনে কমিশন গঠনের পরামর্শ আরেফিনের

1726

॥ মলয় কুমার দত্ত ॥
ঢাকা, ১৫ আগস্ট, ২০২০(বাসস): ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর এ এ এম এস আরেফিন সিদ্দিক ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পুরো হত্যাযজ্ঞের পেছনের ষড়যন্ত্র উদঘাটনে সার্বিক অনুসন্ধান চালাতে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছেন।
জাতীয় শোক দিবসের প্রাক্কালে তিনি আজ বাসসের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে বলেন, সার্বিকভাবে সম্পূর্ণ ষড়যন্ত্র উদঘাটনে তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠন গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখনও পর্যন্ত পরিবারের প্রায় সকল সদস্যসহ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্র অনুসন্ধানে প্রকাশিত গোপন বিদেশী তথ্যের ওপর অধিকাংশভাবে নিভর্রশীল। হত্যাযজ্ঞের পুরো ষড়যন্ত্র উদঘাটনে আমাদের এখন স্থানীয় সূত্রগুলো খুঁজে দেখার পাশাপাশি বিদেশীসূত্র থেকে পাওয়া তথ্য একত্রিত এবং সেসব মিলিয়ে দেখা প্রয়োজন। আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ধাপে ধাপে দীর্ঘকাল ধরে এই ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হয়েছে। আমরা যদি প্রতিটি ধাপ খতিয়ে দেখি বা বিশ্লেষণ করি, তাহলে হয়তো পুরো ঘটনার চেহারাই পাল্টে যাবে এবং দেখা যাবে একটি ঘটনার সাথে অন্যটি কিভাবে জড়িত।
জাতীয় বার্তা সংস্থা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার পরিচালনা পর্ষদের নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান আরেফিন সিদ্দিক বলেন, দৃশ্যপটের নেপথ্য নায়কদের কেউ হয়তো ওয়াশিংটন কিংবা অন্য কোথাও বসে এ প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছিল, আর অন্যরা হয়তো পর্দার আড়ালে থেকে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্যে ঘাতকদের পাঠিয়েছিল।
আমেরিকান সিআইএ’র এ হত্যাযজ্ঞে হাত থাকতে পারে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ইতিহাসের স্বার্থে তাদেরও মুখোশ উন্মোচন করা প্রয়োজন।
সাবেক এই উপাচার্য একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের কথা পুনর্ব্যক্ত করে এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, তারা প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি, মহাত্মা গান্ধী, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধীকে হত্যার পর এ ধরণের তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করেছিল। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে হত্যার সাতদিনের মধ্যে ১৯৬৩ সালের ২৯ নভেম্বর তদন্তের জন্যে একটি কমিশন গঠন করেছিলেন যা অনানুষ্ঠানিক ভাবে ওয়ারেন কমিশন নামে পরিচিত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর হত্যা করা হয়।
যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষজ্ঞ সিদ্দিক আরো বলেন, ওয়ারেন কমিশন সংক্ষিপ্ততম সময়ের মধ্যে তাদের রিপোর্ট পেশ করেছিল, যা পরে সকলের জন্যে উন্মুক্ত করা হয়। এটি লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে যেন বিশ্ববাসী আততায়ীদের দ্বারা সংঘটিত হত্যাযজ্ঞকেন্দ্রিক সঠিক তথ্যসমূহ জানতে পারে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা কেবল একজন ব্যক্তি কিংবা একটি পরিবারের হত্যাযজ্ঞ নয় বরং এটি দেশের পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থা ধসে পড়ারই নামান্তর।
সাবেক এই উপাচার্য আরো বলেন, দেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। কিন্তু এই হত্যার নীল নকশা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বহু আগ থেকেই শুরু হয়েছে এবং পরেও দীর্ঘদিন ধরে চলেছে। কমিশনের মাধ্যমেই এর উদঘাটন করা উচিত।
আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ১৫ আগস্ট হত্যাযজ্ঞের ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্যে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। তিনি বলেন, ষড়যন্ত্র এখনও অব্যাহত আছে। তাই ভবিষ্যতে এ ধরণের ষড়যন্ত্র যাতে না ঘটে সে জন্যে ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচন এবং এই হত্যাযজ্ঞের কেন্দ্রে থাকা পুরো দৃশ্যপট উদঘাটনে কমিশন গঠন জরুরি। তিনি বলেন, এই কমিশন গঠনের অর্থ কাউকে নতুন করে শাস্তি দেয়া নয়। কারণ, ইতোমধ্যে অপরাধীদের বিচার করা হয়েছে। এই কমিশন গঠনের লক্ষ্য ঐতিহাসিক রেকর্ডসমূহ সংরক্ষণ করা এবং প্রজাতন্ত্রের মালিক হিসেবে জনগণের জানার অধিকার রয়েছে কে তাদের জাতির পিতাকে হত্যা করেছে।

কেন্দ্রীয় কমিটির তালিকা ...তিনি বলেন, অত্যন্ত সৎ ও দক্ষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, আমলা, সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রস্তাবিত এই কমিশন গঠন করা যেতে পারে।তিনি আরো বলেন, যারা সরাসরি হত্যাকান্ডে অংশ নিয়েছিল তাদের শনাক্ত ও বিচার করা সহজ। কিন্তু ষড়যন্ত্রের নেপথ্য নায়কদেরও অবশ্যই চিহ্নিত করতে হবে।
হত্যাকান্ড সম্পর্কে নিজস্ব কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে আরেফিন সিদ্দিক কয়েকটি কম উল্লেখিত ঘটনার উল্লেখ করেন, যার একটি তৎকালীন ডেপুটি সেনা প্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমানের চাকুরির মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি। ৭৫ এর ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞের পর, এই জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশে এক শক্তিশালী মানুষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
তিনি বলেন, এ সম্পর্কিত একটি সূত্র বলছে জিয়া তার চাকুরির মেয়াদ বাড়ানোর জন্যে মরিয়া হয়ে তদবির করছিলেন। তবে, বঙ্গবন্ধু কেবলমাত্র তিন মাসের জন্যে তা বাড়াতে সম্মত হয়েছিলেন।
তৎকালীন প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী নূরুল ইসলামের কয়েক বছর আগের প্রকাশিত সাক্ষাতকার, যেখানে তিনি জিয়াউর রহমানের চাকুরির মেয়াদ বাড়ানোর ক্ষেত্রে নিজের ভূমিকার জন্যে অনুতাপ করেছিলেন, থেকে উদ্ধৃত করে সিদ্দিক বলেন, “চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর নির্দেশ পেয়ে জিয়াউর রহমানকে খুবই উল্লসিত দেখা যাচ্ছিল…. এর কিছুদিনের মধ্যেই ১৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়।”
আরেফিন সিদ্দিক বলেন, একাধিক রিপোর্ট বলছে, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার পাওয়া সম্ভাব্য হত্যার ষড়যন্ত্রের খবর বঙ্গবন্ধুকে বারবার জানিয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এসব খুব হালকাভাবে নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাকে হত্যা করবে বাংলাদেশে এমন লোক কে আছে’। সিদ্দিক বলেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। এ কারণে, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কিছু একটা হচ্ছে এবং “একটি ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হচ্ছিল কিন্তু তিনি কখনই এর জন্যে কোন বাঙালিকে দোষারূপ করেননি, এই হলেন বঙ্গবন্ধু।”
এই যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, বই কিংবা প্রবন্ধ নিবন্ধে বিক্ষিপ্তভাবে অনেক কিছুই লেখা হয়েছে, কিন্তু হত্যাকান্ডের পর কে প্রতিরোধ গড়েছিল, কে আত্মহত্যা করেছিল এবং কে কেবিনেটে শপথ নিয়েছিল এবং জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করতে কিভাবে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের ঘটনা ঘটানো হয়েছিল, সেসব জানতে অবশ্যই একটা সার্বিক অনুসন্ধান প্রয়োজন। তিনি বলেন, জনগণ ১৫ আগস্টের হত্যাকান্ডের আগে ও পরের সকল ঘটনা এবং তাতে কার কি ভূমিকা ছিল, তা জানতে চায়। সুতরাং, এই ষড়যন্ত্র এবং এ সম্পর্কিত সকল কিছু সম্পর্কে জনগণকে জানাতে হত্যাযজ্ঞের সরকারি রেকর্ডসমূহ সংরক্ষণে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন জরুরি।
বঙ্গবন্ধুর শাহাদাৎ বার্ষিকী এবং জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে তিনি বলেন, যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে দিনটি পালিত হওয়া উচিত এবং কেউ যেন দিনটিকে কেন্দ্র করে ব্যানার ও পোস্টারের মাধ্যমে আত্মপ্রচারণা চালাতে না পারে, কারণ দিনটি জাতির জন্যে খুবই শোকাবহ।
তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড পরবর্তী সরকার প্রণীত ও বর্তমানে বাতিল কালো আইনের আওতায় ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডের ঘাতকদের সুরক্ষা দেয়া হয়েছিল এবং তৎকালীন সরকার তাদের বিদেশে কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে এবং তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে দেশের মধ্যে রাজনৈতিক দল গঠনের অনুমতি দিয়ে পুরষ্কৃত করেছিল।
২১ বছরের রাজনৈতিক বর্বরতা শেষে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার পর, খুনের সাথে সরাসরি জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে তথাকথিত ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে। তারপর বিলম্বিত এই বিচার প্রক্রিয়া ১৯৯৬ সালে শুরু হয় এবং দীর্ঘ আইনী প্রক্রিয়া শেষে ১২ সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। অবশেষে এদের ৫ জনকে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ফাঁসি দেয়া হয়। বাকীদের তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার করা হয়।
দন্ডপ্রাপ্ত আসমিদের একজন বিদেশে পালিয়ে থাকা অবস্থায় স্বাভাবিকভাবে মারা যায় এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের অপর দন্ডপ্রাপ্ত আসামী আবদুল মাজেদ চলতি বছর ৭ এপ্রিল ঢাকায় গ্রেফতার হওয়ার পর ১২ই এপ্রিল ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর দন্ডপ্রাপ্ত আরেক খুনি রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ভারতে গ্রেফতার হয়েছে বলে কলকাতা ভিত্তিক বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বলা হয়েছে। আর বাকী চারজন এখনও পলাতক রয়েছে।
সরকার বলেছে, তাদের খুঁজে বের করা এবং মৃত্যদন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের মধ্যে দুজনকে ফাঁসি দেয়ার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র ও থাইল্যান্ড থেকে দেশে ফিরিয়ে আনারও প্রক্রিয়া চলছে।