১৫ আগস্ট এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলী

689

॥ আবুল কালাম আজাদ ॥
ঢাকা, ১০ আগস্ট, ২০২০ (বাসস) : জিয়া-মোশতাক খুনি চক্র ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে যান তার সুযোগ্য দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
ঘাতকরা সেদিন বঙ্গবন্ধু পরিবারের পরম আদরের ১০ বছরের শিশু রাসেলকেও রেহাই দেয়নি। সেই কালরাতে শাহাদাত বরণ করেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, শেখ জামাল, তাদের স্ত্রীদ্বয় সুলতানা কামাল, রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসেরসহ অনেকে। খুনিদের জিয়া-খালেদা সযতেœ লালন-পালন করেছেন। বিদেশের দূতাবাসে চাকরি দিয়েছেন। সংসদে আইন করেছেন বিচার না করার জন্য। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তারা ২১ বছর ইতিহাসকে বিকৃত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে প্রবাহিত করেছেন ভিন্ন খাতে। এখনও একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীর মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অবস্থান অব্যাহত রয়েছে।
একটি উদাহরণ দিই- কিছুদিন আগে গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ্্ চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে একটি ‘খোলা চিঠি’ লিখেছেন। সেই চিঠিটি উদ্ধৃত করে একটি নিবন্ধ লিখেছেন ড. মাহবুবউল্লাহ। সেখানে তিনি লিখেছেন- ‘শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুর পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় তখন শেখ হাসিনার তার সঙ্গে দেখা করেননি।’ এটি একটি নির্লজ্জ মিথ্যাচার।
বাস্তবে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুর পর তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া সুধা সদনে যান। তার সঙ্গে মওদুদ আহমদসহ অন্য নেতারা ছিলেন। কিছুক্ষণ নিচে বসার পর বেগম জিয়া দোতলায় যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার জন্য। তারা বেশ কিছু সময় আলাপ-আলোচনা করেন। ঘটনাটি ২০০৯ সালের মে মাসের।
জেনে-শুনে এমন তথ্য বিকৃতি কেন? তখন যেসব ছেলে-মেয়ের বয়স ১০-১২, এখন তারা যুব সম্প্রদায়। এ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার জন্য ইতিহাস বিকৃতি, প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করা কি কোনো কোনো বুদ্ধিজীবীর মজ্জাগত প্রবনতা? তারা অতি চাতুর্যের সঙ্গে লেখা বা কথায় বিষ ঢেলে দেন যা আমাদের অনেকের পক্ষে উপলব্ধি করাও কঠিন হয়ে যায়।
আমাদের মনে আছে, আরাফাত রহমান কোকো মারা যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুলশানে খালেদা জিয়ার অফিসে গিয়েছিলেন, তাকে সহানুভূতি জানাতে। খালেদা জিয়া তখন ভেতরেই ছিলেন। গাড়ি ঢোকার বড় গেটটিতে সঙ্গে সঙ্গে তালা মেরে দেওয়া হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন গাড়ি ছাড়াই ভেতরে ঢোকার উদ্যোগ নেন, তখন ছোট গেটেও তালা মেরে দেওয়া হয়।
খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী, থাকতেন সেনানিবাসে। অনেক সময় সিএমএইচে চিকিৎসাধীন সামরিক বাহিনীর প্রাক্তন সদস্যদের দেখতে গেলে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার গাড়ি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ঢুকতে দেয়া হতো না। জাহাঙ্গীর গেট থেকে সিএমএইচ পর্যন্ত দীর্ঘ পথ তাকে হেঁটে যেতে হতো। এসব আচরণ মতলববাজরা ভুলে যেতে পারে, দেশবাসী ভোলেনি।
প্রসঙ্গক্রমে, আরেকটি ঘটনা মনে পড়ছে। মাছরাঙা টিভির একটি টকশোতে আমি আমন্ত্রিত ছিলাম, আর ছিলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ এবং ড. মাহবুবউল্লাহ। আলোচনার এক পর্যায়ে মাহমুদুর রহমান মান্নার সেই সময়কার একটি আলোচিত ফোনালাপ নিয়ে মতামত চাওয়া হয়। ড. মাহবুবউল্লাহকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, তিনি স্পষ্ট করে কিছু বোঝেননি। তখন আমি বলেছিলাম, আমাদের দুর্ভাগ্য একশ্রেণির পন্ডিত ও বুদ্ধিজীবী নিজেদের পছন্দের বাইরে গেলেই আর কিছু বোঝেন না। সঞ্চালক বুঝলেন, মকসুদ ভাই বুঝলেন, আমি বুঝলাম অথচ মাহবুবউল্লাহ সাহেব মান্নার কথা বুঝলেন না।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তার খোলা চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘পরামর্শ’ দিয়েছিলেন ঈদের দিন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করার জন্য। বলেছেন তাতে নাকি শেখ হাসিনার বিরাট রাজনৈতিক সুবিধা আদায় হবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক সুবিধা দিতে চান জনাব জাফরুল্লাহ? যিনি শেখ হাসিনা ও তার দলকে পরাজিত করতে বিএনপিকে নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠনের অন্যতম উদ্যোক্তা?
আরও কথা আছে। একজন দ-প্রাপ্ত আসামির সঙ্গে কেন দেখা করতে যাবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা? আর ওই আসামি হলেন সেই আসামি, যিনি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন সারাজীবন। সেনাবাহিনীর খুনি আজিজ পাশা জিম্বাবুয়েতে মারা যাওয়ার পর তাকে পদোন্নতি দিয়ে সমুদয় পাওনা তার পরিবারকে দিয়েছেন। খায়রুজ্জামানকে উচ্চ কূটনীতিক পদে বিদেশে চাকরি দিয়েছেন।
খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সরকারের জ্ঞাতসারে হাওয়া ভবনে তারেক জিয়ার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। আল্লাহর অশেষ রহমত ও জনগণের দোয়ায় সে যাত্রায় তার জীবন রক্ষা পায়। গ্রেনেড হামলার পরপরই প্রচার করা হয় শেখ হাসিনার হাতব্যাগ থেকে এ গ্রেনেড ছোড়া হয়েছে। পরে শুরু হয় জজ মিয়া নাটক। দেশবাসীর এখনও মনে আছে সেসব ঘটনা। শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য বিভিন্ন সময়ে কমপক্ষে ২১ বার চেষ্টা করা হয়। কারা এই হামলার অপচেষ্টা চালিয়েছে, এখন আর তা কারও অজানা নেই।
তারপরও আমরা দেখছি, দন্ডপ্রাপ্ত আসামি খালেদা জিয়ার পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ মানবিক কারণে তাকে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেয়া হয়।
বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত দিবস ১৫ আগস্ট। এ দিবসটিতে যাতে শোক পালন করা না যায়, বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করা না যায়, সে জন্য আনন্দ-উৎসবের আয়োজন করা হয়। ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়া ভূয়া জন্মদিন উদযাপন করেন। তার ৪-৫টি জন্মদিনের একটি নির্ধারণ করা হয় ১৫ আগস্ট। তার জন্মদিনগুলোর মধ্যে রয়েছে-ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী ৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৬, বেগম খালেদা জিয়ার শপথ গ্রহন অনুষ্ঠান উপলক্ষে পিআইডির দেয়া তথ্য বিবরণী অনুয়ায়ী-১৯ আগস্ট, ১৯৪৭, কাবিননামা অনুযায়ী ৯ আগস্ট, ১৯৪৪, পাসপোর্ট অনুযায়ী ৫ আগস্ট, ১৯৪৬ এবং ২০০০ সালের ভোটার তালিকা অনুযায়ী ১৫ আগস্ট ১৯৪৬।
খালেদা জিয়া কি জানতেন না ১৫ আগস্ট তার আসল জন্মদিন নয়? তিনি তো কেক কেটে উৎসব করেছেন ঠিকই- কতটা নিষ্ঠুর, অমানবিক। কল্পনারও অতীত। আর তার সঙ্গেই দেখা করতে যেতে হবে জাফরুল্লাহ্্ সাহেবদের পরামর্শে? আবদার কাকে বলে!
দেশের যে কোনো নাগরিক প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিতেই পারেন। প্রধানমন্ত্রীর গঠনমূলক সমালোচনাও করা যায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ব্যক্তি শেখ হাসিনা অত্যন্ত সম্মানিত, মমতাময়ী, ধর্মভীরু, মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তার মেধা, শ্রম, কর্তব্যনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়ণতা, সততা ঈর্ষণীয়। তার দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞা মানুষের জন্য মমত্ববোধ অতুলনীয়। তার প্রজ্ঞা ও মেধা দিয়ে ইতোমধ্যেই তিনি বিশ্বপরিম-লে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেছেন। বিশ্বনেতাদের সমীহ আদায় করেছেন। বিশ্বনেতারা তাকে মমতাময়ী মা উপাধি দিয়েছেন। ব্যক্তি শেখ হাসিনা জানেন, কখন কী করতে হবে।
খোলা চিঠির লেখক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও নিবন্ধ লেখক ড. মাহবুবউল্লাহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমলা, আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দাদের ওপর নির্ভর করতে বারণ করেছেন। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দূরে রাখতে কেন বলা হবে? যারা জীবন বাজি রেখে জঙ্গি সন্ত্রাসীদের দমনের কাজে নিয়োজিত থাকে। দুর্নীতিবাজদের এবং অন্য সমাজ বিরোধীদের বিষয়ে তথ্য দিয়ে গোয়েন্দারা সরকারকে সাহায্য করে। আমলারা নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। সাম্প্রতিক করোনা রোধে আমাদের আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সদস্য, আমলা, গোয়েন্দারা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছেন। তাদের বহুসংখ্যকের প্রাণহানিও ঘটেছে। তাহলে কী কারণে তাদের দূরে রাখতে বলেছেন। সরকারের সঙ্গে তাদের দূরত্ব তৈরি করার উদ্দেশ্য কী? এ কথা ভেবে দেখা দরকার।