ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ মাত্রা বেঁধে দেয়ার নীতিমালা হচ্ছে

367

॥ কানাই চক্রবর্তী ॥
ঢাকা, ২০ জুলাই, ২০২০ (বাসস) : বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ মাত্রা ২ শতাংশে নামিয়ে আনতে একটি নীতিমালা তৈরির কাজ শুরু করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত স্ট্যান্ডার্ড মেনেই শিগগিরই এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হবে।
এর আগে, করোনা প্রাদুর্ভাবের সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পুষ্টি বিষয়ক এক নির্দেশনায় প্রাপ্তবয়স্কদের শিল্প উৎপাদিত ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাবার পরিহার করার পরামর্শ দেয়। সংস্থাটি বলেছে, এই ধরনের অসম্পৃক্ত চর্বি সাধারণত প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফাস্ট ফুড, স্ন্যাক্স, তেলে ভাজা খাবার, হিমায়িত পিজ্জা, পাই, কুকি, মার্জারিন ও স্প্রেডস বা মাখিয়ে খাওয়ার বিভিন্ন খাবার মিশ্রণে পাওয়া যায়।
এছাড়াও, ভবিষ্যতে করোনার মত মহামারী থেকে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপাশি হৃদরোগ ঝুঁকি কমাতে খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা নির্ধারণ করার উপর গুরুত্বারোপ করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। খাবারে ট্রান্সফ্যাটের অনিয়ন্ত্রিত মাত্রা, মোড়কে ট্রান্সফ্যাটের পরিমাণ উল্লেখ এবং চিহ্নিতকরণের বাধ্যবাধকতা না থাকায় সার্বিক পরিস্থিতি দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠছে উল্লেখ করে তারা বলেন, জাঙ্ক ফুড এবং বেকারি পণ্যের উপর মানুষের অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা ট্রান্সফ্যাটজনিত স্বাস্থ্য ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে তুলছে।
জানা গেছে, ট্রান্সফ্যাটের স্বাস্থ্য ক্ষতি থেকে সকল মানুষকে সুরক্ষার জন্য বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২৩ সালের মধ্যে শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট মুক্ত বিশ^ অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এই লক্ষ্য অর্জনে সংস্থাটি ২০১৮ সালে রিইপ্লেস অ্যাকশন প্যাকেজ ঘোষণা করে যেখানে খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট নির্মূলে সরকার কিভাবে কাজ করবে তার নির্দেশনা রয়েছে। ইতিমধ্যে, ভারত, থাইল্যান্ড, ব্রাজিল, তুরস্কসহ পৃথিবীর ৩০টিরও বেশি দেশ খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট একটি নীরব ঘাতক। যার মূল উৎস পারশিয়ালি হাইড্রোজেনেটেড অয়েল বা পিএইচও যা সাধারণত ডালডা বা বনস্পতি ঘি নামে পরিচিত। ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাবার রক্তের এলডিএল বা ‘খারাপ কোলেস্টেরল’ বৃদ্ধি করে, অপরদিকে এইচডিএল বা ‘ভালো কোলেস্টেরল’-এর মাত্রা কমিয়ে দেয়। অতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট গ্রহণে খারাপ কোলেস্টেরল রক্তবাহী ধমনিতে জমা হয়ে রক্তচলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে, হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা অকাল মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
হৃদরোগজনিত কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ২ লক্ষ ৭৭ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ২০১০ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে অন্তত ৮ হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য উচ্চ মাত্রার ট্রান্সফ্যাট গ্রহণ দায়ী।
এ বিষয়ে গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর মুহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস বলেন, হৃদরোগসহ সকল অসংক্রমক ব্যাধি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে। উচ্চমাত্রায় ট্রান্সফ্যাট গ্রহনের কারণে সার্বিকভাবে মৃত্যুঝুঁকি ৩৪ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, একজন ব্যক্তির দৈনিক ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের পরিমাণ হওয়া উচিত মোট খাদ্যশক্তির ১ শতাংশের কম, অর্থাৎ দৈনিক ২০০০ ক্যালোরির ডায়েটে তা হতে হবে ২.২ গ্রামের চেয়েও কম। ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাবার পরিহার করার একমাত্র পথ হলো সচেতনতা। তাই, সচেতনতাই পারে সবাইকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ) ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ মাত্রা ২ শতাংশে নামিয়ে আনার বিষয়ে গত জানুয়ারি মাসে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ বিষয়ে গঠিত ১০ সদস্যের একটি টেকনিক্যাল কমিটি কাজ শুরু করলেও করোনাভাইরাসের প্রকোপে পিছিয়ে পড়ে নীতিমালা চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়া।
এ বিষয়ে টেকনিক্যাল কমিটির সদস্য ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আবু আহমেদ শামীম বলেন, ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ মাত্রা নির্ধারনে আমাদের কাজ অনেক দূর এগোলেও করোনার কারণে নীতিমালা আটকে রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আপাতত এই করোনা সময়ে আমাদের কোনো মিটিং হয়নি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এটি হচ্ছে না বলে মনে করি। তবে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে খুব দ্রুত এটি হয়ে যাবে।’
বিএসটিআই’র সহকারী পরিচালক এনামুল হক বলেন, কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের কারণে মানুষ এখন ঘরে অবস্থান করছে এবং অধিকাংশের শারীরিক কর্মকান্ড অনেকটাই কমে গেছে, তাই সুস্থ থাকতে ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারনে ইতোমধ্যে একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি ।
তিনি বলেন, শিল্পোৎপাদিত ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড নির্মূল ক্রমেই বিশ্বজুড়ে একটি অগ্রাাধিকার হয়ে উঠছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২৩ সালের মধ্যে শিল্পোৎপাদিত ট্রান্স ফ্যাটমুক্ত বিশ^ অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। ভারত, থাইল্যান্ড, ইরান, অস্ট্রিয়া, নরওয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ব্রাজিলসহ মোট ৩০টি দেশে খাদ্য দ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ কার্যকর করেছে। এছাড়া আরো ২৪টি দেশ ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ মাত্রা ২ শতাংশে নামিয়ে আনতে কাজ শুরু করেছে।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ)-র সদস্য মন্জুর মের্শেদ আহমেদ বাসস’কে বলেন, বিএফএসএ ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ মাত্রা ২ শতাংশে নামিয়ে আনতে একটি নীতিমালা তৈরির কাজ শুরু করেছে।
ভোজ্যতেল এবং অন্যান্য খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাটের মাত্রা কমিয়ে আনতে একটি ১০ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং উক্ত কমিটি এরই মধ্যে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার, বিশেষজ্ঞ এবং ভোক্তাদের সাথে
দু’টি আলোচনা সভা সম্পন্ন করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত স্ট্যান্ডার্ড মেনে শিগগিরই এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হবে বলে জানান তিনি।