সুনামগঞ্জে বন্যার পানি হ্রাস পেলে ও দুর্ভোগ বাড়ছে

237

সুনামগঞ্জ,১৬ই জুলাই, ২০২০(বাসস): জেলায় নদী-নালা, হাওর, খাল-বিলের পানি ধীর গতিতে হ্রাস পেলেও দুর্ভোগ বাড়ছে। সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর, বিশ^ম্ভরপুর, দোয়ারাবাজার, ছাতক ও জামালগঞ্জ উপজেলার সঙ্গে জেলা শহরের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। ফলে বিশুদ্ধ পানীয় জলসহ মানুষ ও গবাদি পশুর খাদ্য সংকটে বানভাসীরা পড়েছেন বিপাকে। দু’ দফা বন্যায় ইরি বোরো, রোপা আমনের বীজতলা ও সবজি ক্ষেত বিনষ্ট হওয়াতে চরম বিপাকে বানভাসীরা।
দোয়ারাবাজারে সুরমাসহ সকল নদী-নালা, হাওর, খাল-বিলের পানি ধীর গতিতে হ্রাস পেলেও দুর্ভোগ বাড়ছে । গত তিনদিন তেমন বৃষ্টিপাত না হলেও গত মঙ্গলবার রাতভর আবারও ভারি বর্ষণ হলে ভাটিতে পানির টান না থাকায় নি¤œাঞ্চলের পানি এখনও থমকে আছে। উপজেলা সদরের সাথে বিভিন্ন ইউনিয়নের সংযোগ সড়কগুলোর অবস্থা এমনিতেই ছিল নাজুক, তার উপর লাগাতার ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে প্রথম দফা বন্যার পানি না নামতেই সপ্তাহকাল ব্যবধানে ফের বন্যায় ‘মরার উপর খরার ঘা’। এতে সংকটে বানভাসীরা পড়েছেন বিপাকে। এ দিকে উপর্যুপরি দু’দফা বন্যায় খামারিদের মাছের ঘের ভেসে যাওয়াসহ উঠতি আউশ, ইরি বোরো, রোপা আমনের বীজতলা ও সবজি ক্ষেত বিনষ্ট হওয়াতে চরম বিপাকে পড়েছে উপজেলাবাসী। আগামী আমন ফসল উৎপাদন অনেকটাই অনিশ্চিত ভেবে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন হাজার হাজার কৃষিজীবী পরিবার। তাই অচিরেই দোয়ারাবাজার উপজেলাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার মাধ্যমে বন্যা পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বিনা সুদে কৃষিঋণ ও কৃষি উপকরণসহ বিনামূল্যে রোপা আমনের বীজ ও চারা বিতরণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছেন দোয়ারাবাজারবাসী।
এদিকে, দোয়ারাবাজার-বগুলাবাজার সড়কের ভাঙনের ফলে লক্ষীপুর, সুরমা ও বাংলাবাজার (আংশিক) ইউনিয়নের অন্তত অর্ধশতাধিক গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছে। দোয়ারাবাজার-বাংলাবাজার, দোয়ারাবাজার-নরসিংপুর ভায়া ব্রিটিশ-বালিউরা, নরসিংপুর-চাইরগাঁও (ক্যাম্পেরবাজার) সড়কেরও একই দশা। ফলে নরসিংপুর, বাংলাবাজার ও দোয়ারা সদর (আংশিক) ইউনিয়নবাসীও চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। এমনিতে প্রয়োজনীয় লোকবল ও সুষ্ঠু তদারকির অভাবে সারা বছর জুড়েই শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ীসহ সাধারণ পথচারীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয় এসব ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে।
জেলার শ্রেষ্ঠ মৎস্য খামারি আব্দুর রহিম বলেন, দু’দফা বন্যায় শতাধিক পুকুরের কয়েক কোটি টাকার মাছ ভেসে যাওয়ায় আমরা বিপাকে পড়েছি। আমাদের এ ক্ষতি অপূরণীয়। অপরদিকে বাকিতে আনা মাছের খাদ্য ও পোনা বাবদ ডিলার ও মহাজনদের লাখ লাখ টাকার দেনা পরিশোধ নিয়ে চোখে সর্ষেফুল দেখছি আমরা।
চিলাই নদী পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক শিব্বির আকন্দ (সাব্বির) বলেন, খাসিয়ামারা ও চিলাই নদীর বেড়িবাঁধ নির্মাণে অনিয়মে সাম্প্রতিক উপর্যুপরি দু’দফা বন্যার তোড়ে দোয়ারাবাজার-বগুলা-লক্ষীপুর সড়কে ৩-৪ স্থানে বড় বড় ভাঙনে ফসলি জমি, রাস্তাঘাট ও মাছসহ সব হারিয়ে আজ আমরা চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন।
সুরমার উপজেলা নদীভাঙন প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি তাজুল ইসলাম বলেন, উপজেলা পরিষদ ভবন সম্মুখস্থ সড়কে ফাঁটল, ভাঙন, দোয়ারাবাজার-লাফার্জ সড়কে বিভিন্ন ব্রিজের এপ্রোচসহ বিভিন্ন স্থানে ভাঙনের কারণে সড়ক যোগাযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া, ওই সড়কে গত বছরের বন্যায় অর্ধ কিলোমিটার রাস্তা ও বাড়িসহ ৭টি দোকান সুরমায় বিলীন হয়ে গেছে। এবারের প্রথম দফা বন্যায় উপজেলা পরিষদের সম্মুখভাগে আরও দুটি দোকানঘর ধসে গিয়ে সুরমায় তলিয়ে গেছে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নিউটন দাস বলেন, পরপর দু’দফা বন্যার ¯্রােতে ছাতক-দোয়ারাবাজার-সুনামগঞ্জ সড়কে মান্নারগাঁও ইউনিয়নের নোয়াগাঁও খালের ব্রিজের পূর্বদিকে বৃহৎ এলাকাজুড়ে ভাঙনসহ ওই সড়কের বিভিন্ন স্থানে ফাঁটল ও ভাঙনের ফলে জেলা সদরের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারেই বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ইউনিয়নের ক্ষেত-খামার সবই তলিয়ে গেছে। এখন উজানের ইউনিয়নগুলো থেকে পানি নামতে শুরু করলেও ভাটিতে অবস্থিত মান্নারগাঁও ইউনিয়নের আমবাড়ি ও কাটাখালী বাজারসহ সবক’টি গ্রামের রাস্তাঘাট ও লোকালয়ে এখনও কোমর সমান পানি থৈ থৈ করছে। অনেক পরিবারের উঁনুনে হাড়িই বসছেনা। তাই বন্যা পরবর্তী দ্রুত রাস্তা সংস্কারসহ ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জোর দাবি জানাচ্ছি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার সোনিয়া সুলতানা বলেন, বর্তমানে সুরমাসহ সকল নদনদী ও হাওর খাল-বিলের পানি ক্রমশ নামতে শুরু করেছে। উপদ্রুত এলাকায় এ যাবত ৪০ মেট্রিক.টন চাল, শুকনো খাবার, রান্নাকরা খাবার, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও পানি বিতরণসহ আমাদের ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। জনপ্রতিনিধিদের প্রণয়ণকৃত তালিকা মোতাবেক বন্যা পরবর্তী ভুক্তভোগীদের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
সুনামগঞ্জ , পাহাড়ি ঢল আর ভারীবৃষ্টিপাতে সুনামগঞ্জে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও জনদুর্ভোগ বেড়েছে। গতকাল বুধবার বিকেল ৩ টায় সুরমা নদীর পানি সুনামগঞ্জ ষোলঘর পয়েন্টে বিপদ সীমার ৪ সেন্টিমিটার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল । আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় সুনামগঞ্জ ষোলঘর পয়ন্টে বিপদ সীমার ১১ েেসন্টিমিটার নীচ দিয়ে প্রবাহিত বাহিত হচ্ছ।বন্যার পানি ধীর গতিতে কমলেও হাওর এলাকায় জনদুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় গতকাল বুধবার সকাল ৯ টায় ৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, ১৫ মে পর্যন্ত হাওরের ফসল রক্ষার জন্য সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমা ছিল ৬ দশমিক ৫০ সেন্টিমিটার এবং ১৫ মে’র পরে বিপদ সীমা হল ৭ দশমিক ৮০ সেন্টিমিটার। ৭ দশমিক ৮০ সেন্টিমিটার অতিক্রম করলেই বর্ষাকালে সুরমা নদীর পানি বিপদ সীমা ধরা হয়।
গতকাল বুধবার বিকেল পর্যন্ত পানি কিছুটা কমলেও জেলার তাহিরপুর উপজেলা, বিশ^ম্ভরপুর, দোয়ারাবাজার, ছাতক ও জামালগঞ্জ উপজেলার সঙ্গে জেলা শহরের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। এছাড়াও বন্যার পানিতে ছাতক-সিলেট সড়কে সকল ধরনের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে ।
এর আগে বন্যাপূর্বাবাস কেন্দ্রের বরাত দিয়ে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ স্বাক্ষরিত বন্যার সতর্কতা জারি করা হয়েছিল। জেলা উপজেলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। এক সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক দলগুলো প্রস্তুত রাখতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল
সূত্র জানায়, বন্যায় জেলার ৮২টি ইউনিয়নের দুই শতাধিক গ্রামের মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানাযায়, গত মঙ্গলবার পর্যন্ত জেলার ১ লাখ ২হাজার ৭২৯টি পরিবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলার ১১টি উপজেলা ও ৪ টি পৌরসভায় ২৬৯টি আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রয়েছে। এছাড়াও জেলায় ৮৫৫ মেট্রিক টন চাল, নগদ ৪৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা, ১ হাজার ৯ প্যাকেট শুকনা খাবার, ২ লাখ টাকার শিশু খাদ্য ও ২ লাখ টাকার গো-খাদ্য বিতরণ করা হয়েছে। আরও এক হাজার বান্ডেল ঢেউটিন, পাঁচ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, নগদ ২০ লাখ টাকা, পাঁচ শত মেট্রিক টন চাল ও পাঁচ লাখ টাকার গোখাদ্য চাহিদা রয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ২৮ জুন সকাল ৯টায় সুনামগঞ্জের ষোলঘর পয়েন্টে ৮ দশমিক ৫০ সেন্টিমিটার রেকর্ড করা হয়েছিল। যা বিপদ সীমার ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। একই সময়ে গত ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ২১৩ মিলিমিটার।