করোনা সংকটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য স্বস্তি

350

// একেএম কামাল উদ্দিন চৌধুরী //
ঢাকা, ৩০ জুন, ২০২০ (বাসস) : বৈশ্বিক মহামারী করোনা সংকট মোকাবেলায় সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনে স্বস্তি এনেছে।
করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে গত ২৬ মার্চ থেকে সরকার সাধারণ ছুটি, লকডাউন, কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধসহ বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করে। এর ফলে সারাদেশের লাখ লাখ দিনমুজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কবলে পড়ে। এসময় নি আয়ের মানুষের আর্থিক কষ্ট লাঘবের জন্য সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির উপর বিশেষ জোর দেয়।
ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার বগাদনা গ্রামের দিনমুজুর আবু ছায়েদ জানান, সবকিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবারের জীবিকা নির্বাহ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন। কিন্তু, সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন আর্থিক ও খাদ্য সহায়তা তাদের দুশ্চিন্তা কিছুটা হলেও লাঘব করেছে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সরকার ৫০ লাখ পরিবারকে নগদ সহায়তা, মানবিক সহায়তা কর্মসূচি, বিশেষ ওপেন মার্কেট সেল (ওএমএস), ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট (ভিজিডি) এবং ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং (ভিজিএফ)সহ বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির মাধ্যমে সহায়তা দিচ্ছে। এতে শুধু আবু ছায়েদ নয়, দেশের লাখ লাখ দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ উপকৃত হচ্ছে।
দুই সন্তানের জনক আবু ছায়েদ দিনমজুরী করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাই, প্রতিদিনই তার কোন না কোন কাজ থাকতো। এজন্য কখনই উল্লেখযোগ্য আর্থিক সমস্যায় পড়েননি। আবার সঞ্চয়ও গড়ে তুলেন নি। এবার হঠাৎ কোভিড-১৯ এর সংকটে তিনি বেশ সমস্যায় পড়েন। পরিবার নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি সরকারের আর্থিক সহায়তা কর্মসূচির আওতায় তার বিকাশ একাউন্টের মাধ্যমে ২,৫০০ টাকা পেয়েছেন।
কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বিজয়করা গ্রামের কৃষক আবুল হাশেমও নগদ সহায়তা হিসেবে ২,৫০০ টাকা পেয়েছেন।
আবুল হাশেম বলেন, করোনা ভাইরাস মহামারীর কারণে আমি আমার ফসল বিক্রি করতে অসুবিধার মুখোমুখি হয়েছিলাম। এতে আমার আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। গত কয়েক মাস পরিবারের ব্যয় নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়েছিলাম। এই পরিস্থিতিতে, সরকারের আর্থিক সহায়তা আমার খুবই উপকার হয়েছে।
বাসস-এর সাথে আলাপকালে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, সরকার কোভিড -১৯ এর মধ্যে দরিদ্র ও শ্রমজীবীদের ভোগান্তি দূর করতে ১,২৫০ কোটি টাকার নগদ সহায়তার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মোবাইল ব্যাংকিং-বিকাশ, রকেট, নগদ এবং শিওরক্যাশ-এর মাধ্যমে এসময়ে ক্ষতিগ্রস্থ ৫০ লাখ পরিবারের প্রত্যেককে ২,৫০০ টাকা বিতরণ কার্যক্রম গত ১৪ মে উদ্বোধন করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৫০ লাখ পরিবারের মধ্যে এ পর্যন্ত ১৭ থেকে ১৮ লাখ পরিবার সরকারের এই বিশেষ আথির্ক সহায়তা পেয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক (ত্রাণ) মো. ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, তারা তাদের মানবিক সহায়তা কর্মসূচি ও ভিজিএফ কার্ডের আওতায় দরিদ্র মানুষের মধ্যে চাল, ডাল, তেল, লবণ এবং আলুসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী বিতরণ করছেন।
তিনি বলেন, ‘গত তিন মাসে আমরা সারাদেশে ৬৪ টি জেলায় প্রায় ২.১১ লক্ষ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করেছি।’
খাদ্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. হারুন-উর-রশিদ জানান, গত তিন মাসে সরকার বিশেষ ওএমএস কর্মসূচির আওতায় প্রায় ৫৫ হাজার মেট্রিক টন চাল প্রতি কেজি দশ টাকায় বিক্রি করেছে।
তিনি বলেন, তিন মাসে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় গ্রামাঞ্চলে ৪.৫০ লাখ মেট্রিক টন চাল বিক্রি করেছে। এছাড়াও, মুক্তিযোদ্ধা, প্রবীণ ব্যক্তি, বিধবা, শারীরিক প্রতিবন্ধী এবং স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাসহ বিপুল সংখ্যক মানুষ বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় ভাতা পাচ্ছেন।
সরকার কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের ভোগান্তি কমানোর জন্য ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বরাদ্দ আরও বাড়িয়েছে।
এই খাতে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মোট বাজেটের ১৬.৮৩ শতাংশ এবং জিডিপির ৩.০১ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ৮১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। আমরা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহায়তার পাশাপাশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কল্যাণে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছি।
তিনি আগামী অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিতে বিভিন্ন খাতের আওতা বাড়ানোর প্রস্তাব করেন। করোনা মহামারির কারণে সর্বাধিক দারিদ্র্যপ্রবণ ১০০ উপজেলায় বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী সব দরিদ্র, প্রবীণ ব্যক্তিকে বয়স্ক ভাতার আওতায় আনা হবে। এতে ৫ লাখ নতুন উপকারভোগী যুক্ত হবেন এবং এ খাতে ৩০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়া হবে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘করোনা মহামারির কারণে সর্বাধিক দারিদ্র্যপ্রবণ ১০০
উপজেলায় বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী সব বিধবা ও স্বামী পরিত্যাক্তা নারীকে ভাতার আওতায় আনা হবে। এতে সাড়ে তিন লাখ নতুন উপকারভোগী যুক্ত হবে এবং এ খাতে ২১০ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়া হবে।’
অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, সর্বশেষ প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ অনুযায়ী ২ লাখ ৫৫ হাজার নতুন ভাতাভোগী যুক্ত করে অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা ভোগীর সংখ্যা ১৮ লাখে বৃদ্ধি করা হবে। এ বাবদ ২২৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দের প্রয়োজন।
এছাড়াও, দরিদ্র মায়ের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা, কর্মজীবী ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা, ভিজিডি কার্যক্রম, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা, অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে শিক্ষা উপবৃত্তি ও প্রশিক্ষণ, ক্যান্সার, কিডনি ও লিভার সিরোসিস রোগীদের সহায়তা, চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি ইত্যাদি কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
তিনি বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পল্লী অঞ্চলের দারিদ্র্য দূরীকরণের কৌশল হিসেবে ১৯ টি থানায় ১৯৭৪ সালে প্রথম ‘পল্লী সমাজসেবা কর্মসূচি’ শুরু করেছিলেন।