এডিস মশার প্রাদুর্ভাব কমে ডেঙ্গু রোগী শূন্যের কোটায়

626

॥ মো. সাজ্জাদ হোসেন ॥
ঢাকা, ২৫ জুন, ২০২০ (বাসস): এডিস মশার প্রাদুর্ভাব কমে যাওয়ায় দেশের হাসপাতালগুলোতে নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে।
রোগতত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর বুধবারের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২৪ ঘন্টায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কোন হাসপাতালে নতুন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়নি।
আইইডিসিআর’র হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার জানান, গত ১ জানুয়ারি থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগ নিয়ে ৩১৮ জন ভর্তি হয়েছিলেন। এদের মধ্যে ৩১৪ জন সুস্থ হয়ে বাসায় চলে গেছেন। বর্তমানে ঢাকা শিশু হাসপাতালে ৩ জন এবং সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ)-এ ১ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। নতুন কোন রোগী আর হাসপাতালে ভর্তি হননি।
ডা. আয়েশা আক্তার জানান, চলতি বছর ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে দেশে কোন রোগীর মৃত্যুর তথ্য আইইডিসিআর এর কাছে নেই।
করোনার মহাদুর্যোগে ডেঙ্গু ও চিকনগুনিয়া থেকে নগরবাসীকে রক্ষায় দেশের অন্যান্য স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার লার্ভা ও মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
১৩ মে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের পর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)’র মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ডেঙ্গু থেকে নগরবাসীকে রক্ষায় মশক নিধনকে গুরুত্ব দিয়ে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেন।
নগরবাসীকে ডেঙ্গু থেকে রক্ষায় নগরীর ৪০টি স্থানে বিনামূল্যে ডেঙ্গু সনাক্তের পরীক্ষার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি ৬ জুন থেকে ১০ দিনব্যাপী ওই সিটির ৫৪টি ওয়ার্ডে চালানো হয় বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান বা চিরুনি অভিযান। গত ১৫ জুন শেষ হয় এই অভিযান।
অভিযানকালে বিভিন্ন ভবনে এডিস মশার লার্ভা পাওয়ায় সংশি¬ষ্ট ভবন মালিকদের মোট ২৪ লাখ ১০ হাজার ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়। পরবর্তীতে একই অপরাধে কেউ অভিযুক্ত হলে আরও কঠোর শাস্তি এমনকি জেল পর্যন্ত হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ।
১০ দিনে ডিএনসিসির ৫৪টি ওর্য়ার্ডে মোট ১ লাখ ৩৪ হাজার ১৩৫টি বাড়ি, স্থাপনা ও নির্মাণাধীন ভবন পরিদর্শন করে মোট ১ হাজার ৬০১টিতে এডিস মশার লার্ভা এবং ৮৯ হাজার ৬২৬টি বাড়ি/স্থাপনায় এডিস মশা বংশবিস্তার উপযোগী পরিবেশ পাওয়া যায়। অর্থাৎ অভিযানে দেখা যায় ডিএনসিসির শতকরা প্রায় ৬৭ ভাগ স্থাপনায় এডিসের বংশবিস্তারের উপযোগী পরিবেশ বিরাজমান এবং শতকরা প্রায় ১.২ ভাগ স্থাপনায় এডিসের লার্ভা পাওয়া যায়।
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নগরবাসীকে ডেঙ্গু থেকে সুরক্ষা দিতে ডিএনসিসি এই বিশেষ পরিচ্ছন্নতা অভিযান (চিরুনি অভিযান) পরিচালনা করা হয়।
আগামী মাসেই ডিএনসিসি’র চিরুনি অভিযানের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হবে বলে মেয়র আতিকুল ইসলাম বাসস-কে জানান।
প্রথম পর্যায়ের অভিযানের সফল সমাপ্তিতে সংশি¬ষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘করোনার ভয়কে জয় করে এই চিরুনি অভিযান সফল করতে ওয়ার্ড কাউন্সিলর, ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং গণমাধ্যম কর্মীদের সাহসী ভূমিকা সবমহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে। আগামী মাসে আমরা দ্বিতীয় পর্যায়ে চিরুনি অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। আমি আশা করি তখনও আপনাদেরকে এভাবেই আমাদের পাশে পাবো।’
তিনি বলেন, অভিযানে প্রতীয়মান হয়েছে যে, নগরবাসীর অনেকের মধ্যে নির্মাণাধীন ভবন, বাড়ি ও স্থাপনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয়ে আরো সচেতনতা প্রয়োজন।
এবারের চিরুনি অভিযানের অন্যতম সংযোজন ছিলো অ্যাপের মাধ্যমে ডাটা সংগ্রহ ও ব্যবস্থাপনা শুরু করা। চিরুনি অভিযান চলাকালে যেসব বাড়ি/স্থাপনা এডিস মশার লার্ভা কিংবা এডিস মশা বংশবিস্তারের উপযোগী পরিবেশ পাওয়া গেছে- তার ছবি, ঠিকানা ও মালিকের মোবাইল নম্বরসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে একটি বিশেষ অ্যাপে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এর ফলে চিরুনী অভিযান শেষে ডিএনসিসির কোন কোন এলাকায় এডিস মশা বংশবিস্তার করে তার একটি ডাটাবেস তৈরি হবে। ডাটাবেস অনুযায়ী পরবর্তীতে ধাপে তাদেরকে মনিটর করা সহজ হবে।
প্রথম ধাপে অভিযান পরিচালনার উদ্দেশে প্রতিটি ওয়ার্ডকে ১০টি সেক্টরে ভাগ করে প্রতিটি সেক্টরকে ১০টি সাবসেক্টরে ভাগ করা হয়েছিলো। প্রতিদিন প্রতিটি ওর্য়াডের ১টি সেক্টরে অর্থ্যাৎ ১০টি সাবসেক্টরে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। প্রতিটি সাবসেক্টরে ৪ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও ১ জন মশক নিধনকর্মী সমন্বয়ে গঠিত টিম অর্থাৎ প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রতিদিন ৪০ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও ১০ জন মশককর্মী বিভিন্ন বাসা-বাড়ি, স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানে গিয়ে কোথাও এডিস মশার লার্ভা আছে কিনা, কোথাও তিন দিনের বেশি পানি জমে আছে কিনা বা ময়লা-আবর্জনা আছে কিনা যা এডিস মশার বংশবিস্তারে সহায়ক সেটি পরিদর্শন করে সেসব স্থানে লার্ভা ধ্বংস করে কীটনাশক প্রয়োগ করেছে।
এই চিরুনি অভিযানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ৯ জন কীটতত্ববিদ, ডিএনসিসির ৩ জন কীটতত্ববিদ, স্বাস্থ্য বিভাগ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের কর্মকর্তাগণ প্রত্যক্ষভাবে কাজ করছেন বলে ডিএনসিসি সূত্র জানান।
এছাড়া নগরীর প্রতিটি হাসপাতাল এবং ক্লিনিকে রোগী, ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী ও রোগীর স্বজনসহ সংশি¬ষ্টদের ডেঙ্গু থেকে রক্ষায় বিশেষ মশক নিধন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
এদিকে ১৬ মে দায়িত্ব গ্রহণের পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস মশক নিধন ও পরিছন্নতার গতানুগতিক কার্যক্রমকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেন।
তিনি বলেন, নগরবাসীকে গতবছরের মতো যেন মশার অত্যচার সহ্য করতে না হয়, সে লক্ষে মশক নিধনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘সম্মানিত নগরবাসীদের গত বছরের ন্যায় যেন মশার অত্যচার সহ্য করতে না হয় সে লক্ষে আমি মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণ করেই মশক নিধনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছি।’
মশক নিধনে তিনি ডিএসসিসির বছরব্যাপী কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। ৭ জুন মেয়র তাপস নগরীর নবাবগঞ্জ পার্কে এই মশকমুক্তকরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। নগরীর ৭৫টি ওয়ার্ডে বছরব্যাপী একযোগে এই কার্যক্রম চলবে বলে মেয়র জানান।
মেয়র তাপসের পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতি ওয়ার্ডে ৮ জন মশককর্মী সকাল ৯টা থেকে শুরু করে দুপুর ১টা পর্যন্ত লার্ভিসাইডিং করছে। অন্যদিকে ওয়ার্ড প্রতি ১০ জন মশক ক্রু দুপুর আড়াইটা থেকে শুরু করে বিকেল সাড়ে ৬ টা পর্যন্ত ফগিং কার্যক্রম চালায়। ওয়ার্ড কাউন্সিলররা সরাসরি এসব কাজের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন।
এ কার্যক্রম যথাযথভাবে চললে আগামী বছর থেকে মশার প্রজনন ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে মেয়র বলেন, ‘নগরবাসী ডেঙ্গ/চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হোক তা আমরা চাইনা। আর এ কারণেই করোনার এ মহামারীর মধ্যেও মশক নিধন কার্যক্রম বেগবান করা হয়েছে এবং ২৪ ঘন্টা একাজ চলবে।’
এদিকে ১৪ জুন থেকে জলাশয় এবং নর্দমা পরিস্কার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। জলাশয়গুলোতে তেলাপিয়া মাছ চাষের পাশাপাশি পাতি হাঁস পালন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে যাতে জলাশয়গুলো সচল থাকে এবং মশার লার্ভা থাকতে না পারে।
মশক নিধন কার্যক্রমের পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, রাস্তা-ঘাট নর্দমা সংস্কার, ফুটপাত অবৈধ দখলমুক্ত করা, যানজট নিরসন ইত্যাদি বিষয়েও গুরুত্ব দিয়ে কার্যক্রম নেয়া হচ্ছে বলে মেয়র তাপস বাসসকে বলেন।