বাসস দেশ-৯ : করোনা বিপর্যয়ে মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে পারস্পরিক সংবেদনশীলতা চর্চার পরামর্শ

138

বাসস দেশ-৯
দশ-মানসিক স্বাস্থ্য-করোনা
করোনা বিপর্যয়ে মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে পারস্পরিক সংবেদনশীলতা চর্চার পরামর্শ
ঢাকা, ২৪, জুন, ২০২০ (বাসস) : করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ এর সংক্রমণে সারাবিশ্ব আজ বিপর্যস্ত। দিন দিন করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। এই ভয়াবহ মহামারী মোকাবেলা করতে গিয়ে বাড়ছে মানসিক অবসাদ, আতংক ও অনিশ্চয়তা। এ পরিস্থিতিতে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সংবেদনশীল আচরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞগণ।
মানুষের জীবনই শুধু নয়, জীবিকা উপার্জনের পথসহ সবকিছুই এখন স্থবির হয়ে পড়েছে। বদলে গেছে জীবনযাত্রার ধরণ। বাড়ছে মনো-সামাজিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা।
মানসিক স্বাস্থ্য ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বৈশ্বিক এই মহামারিতে মানসিক চাপ বোধ করা স্বাভাবিক। এমন পরিস্থিতিতে প্রত্যেকের মানসিক স্বাস্থ্যের যতœ নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করোনার কারণে মানসিক চাপে কেউ যাতে দুর্বল হয়ে না পড়েন, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে এবং পরস্পরের প্রতি সংবেদনশীল আচরণ করতে হবে। তারা এই দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য প্রত্যেককে মানসিক শক্তি ও সুস্থতা বজায় রাখার পরামর্শ দেন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বাসসকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন হওয়াই স্বাভাবিক। সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে আমরা এ বিষয়ে ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করেছি। এই পরিস্থিতিতে রোগ নির্ণয় ও মানসম্মত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেয়ার জন্য ড. হেলাল নীতি-নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
তিনি বলেন, বেশিদিন হতাশার মধ্যে থাকলে মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাসহ অসহিষ্ণু আচরণ বেড়ে যেতে পারে। তিনি জানান, ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় শিশু-কিশোর এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় দুটি গাইড লাইন তৈরি করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে পরিবারের সদস্যদের একে অন্যকে সাহায্য করতে হবে। পরস্পরকে সময় দিতে হবে। সময় মতো ঘুমের ব্যাপারে সর্তক থাকতে হবে। আশপাশের পরিবেশকে সুন্দর করে রাখতে হবে। চারদিকে মৃত্যু দেখে বৃদ্ধরা মৃত্যু ভয়ে ভুগতে পারেন। তিনি পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, কর্মময় জীবন থেকে হঠাৎ করে কর্মহীন থাকা মানসিক সমস্যার অন্যতম কারণ। স্বাভাবিক ভাবেই মন বিদ্রোহী আচরণ করবে। তারপরও এমন সময় মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে নিয়মানুবর্তী ও স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করার কোনো বিকল্প নেই। নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। স্বজনদের সঙ্গে কথা বলা, বই পড়া বাড়াতে হবে। নিজেকে সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. মেখলা সরকার বলেন, দীর্ঘ সময় বাইরে না যাওয়ার ফলে শিশুরা ভয় পেতে পারে, বিরক্ত হতে পারে, রাগ করতে পারে, হতাশ হতে পারে, দুষ্টামি বেড়ে যেতে পারে। এটা স্বাভাবিক। তিনি বাচ্চাদের অযথা বকাঝকা না করতে অভিভাবকদের পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, অতিরিক্ত বকাঝকা শিশুকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিতে পারে। এতে করে এই কঠিন সময় আরো দুর্বিষহ হতে পারে। অন্য সময় ব্যস্ততার কারণে শিশু মা-বাবাকে কাছে পায় না। এই সুযোগটা কাজে লাগানো উচিত। শিশুদের প্রতি বেশি মনোযোগ ও সময় দেয়া উচিত। এতে শিশুর একঘেয়েমিও কাটবে, বাবা-মা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে শিশুর বন্ধনও দৃঢ় হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ঘরবন্দি অবস্থায় থাকতে থাকতে শিশুদের মধ্যে মানসিক অবসাদ তৈরি হতে পারে। যা তাদের মনোজগতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। ভয় যেন শিশুর মনকে ঘিরে ধরতে না পারে সেদিকে বেশি খেয়াল রাখতে হবে। শিশুরা যাতে একটি মানসিক চাপমুক্ত পরিবেশ পায় সেদিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে। তারা শিশুদের সাথে পরিবারের অভিভাবকদের অবসরের মুহূর্তগুলো আনন্দময় করে তুলতে এবং একঘেয়েমি কাটাতে ইনডোর খেলায় মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ দেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনাকালে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হলে নিজেকে দিনভর সচল রাখতে হবে। নেতিবাচক চিন্তা ভাবনা দূর করতে গান শোনা, বই পড়া, ছবি আঁকা, বাগান করার মতো সৃজনশীল কাজে নিজেকে যুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি পর্যাপ্ত পানি পান এবং সুষম খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস করতে হবে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ড. ওয়াজেদ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইন্সটিটিউট’ ও অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটির ‘স্কুল অব সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ বিভাগের উদ্যোগে সমীক্ষাটি পরিচালিত হয়। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে লক-ডাউন চলাকালীন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সংমিশ্রিত এবং স্বপ্রণোদিত অনলাইন জরিপ পরিচালনা করা হয়।
গবেষণা ফলাফলে দেখা যায়, উত্তরদাতাদের ৯১ দশমিক ৪ শতাংশ এ মহামারী পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাদের মধ্যে ৭২ দশমিক ৮ শতাংশ উত্তরদাতা অনিদ্রায় ভুগছেন, ৭১ দশমিক ৬ শতাংশ উত্তরদাতা এ মহামারী পরিস্থিতিতে বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ এবং ৬৩ দশমিক ৫ শতাংশ উত্তরদাতা ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা ও শঙ্কার কথা উল্লেখ করেন। ৬৮ দশমিক ২ শতাংশ উত্তরদাতাদের মতে এ মহামারী পরিস্থিতিতে সামগ্রিকভাবে তারা আতঙ্কিত এবং বেশিরভাগ (৫৯ দশমিক ৪ শতাংশ) উত্তরদাতা বলেছেন, যে তাদের কাছে জীবন অর্থহীন হয়ে পড়েছে।
উল্লেখ্য, অনিদ্রা, বিরক্তি, বিমলতা, উদ্বিগ্ন অবস্থা,নেতিবাচক চিন্তা আতঙ্ক এবং উত্তরদাতাদের হতাশাপূর্ণ বক্তব্য থেকে সহজেই অনুমেয় যে করোনাভাইরাস মহামারী বাংলাদেশের মানুষের মানসিক অবস্থার উপর ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছে।
বাসস/বিকেডি/এমজে/১৪১৫/-অমি