করোনা পরিস্থিতির কারণে চলতি বর্ষায় শুটকি শ্রমিকরা কঠিন দিন গুণছে

401

ঢাকা, ২০ জুন, ২০২০ (বাসস): শুটকি শুকানোর কাজে নিয়োজিত শ্রমিক মমতাজ বেগম গত বছর বর্ষা মৗসুমেও সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাছ শুকাতে ব্যস্ত ছিলেন। করোনার কারণে এবার তাকে বসে দিন গুণতে হচ্ছে।
তিন সন্তানের জননী মমতাজ বলেন, আমি গত বছরের মে মাসে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠার পর কোন বিরতি ছাড়াই সূর্যাস্ত পর্যন্ত কক্সবাজারের একটি শুটকি মাছের ইউনিটে কাজ করতাম।
কিন্তু এ বছর শুটকি মাছ উৎপাদনের ভরা মৌসুম এপ্রিল এবং মে মাসে শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে বসে রয়েছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে তারা বাড়িতে বসে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। মালিকরাও তাদের শুটকির ইউনিট বন্ধ করে দিয়েছে।
মমতাজ আরও বলেন, এ বছর উৎপাদনের ভরা মৌসুমে আমাদের কোন কাজ নেই। এছাড়াও, বর্ষাকালে আমাদের কর্মহীন বসে তাকতে হবে বলে আমাদের দুর্দশা আরও বাড়াবে।
বাংলাদেশে শুটকি মাছ উৎপাদনের সময়কাল হচ্ছে সেপ্টেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত। অনুকূল আবহাওয়া থাকলে এপ্রিল ও মে মাসে শুটকি মাছের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ উৎপাদিত হয় । এই বছর, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে ভরা মৌসুমে শুটকি মাছের উৎপাদন স্থগিত রাখা হয়েছে।
উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার, খুলনা ও সাতক্ষীরায় প্রায় ৫০টি গ্রাম রয়েছে যেখানে শুটকি মাছ উৎপাদন করা হয়। গ্রামগুলোতে এক লক্ষেরও বেশি মানুষ এই খাতের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।
সূর্যের আলো নেই, কোন কাজও নেই:
সাধারণত জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত বর্ষাকালে শুটকি মাছ শ্রমিকদের পর্যাপ্ত কাজ থাকে না। এই কারণে তাদের সঞ্চয় থেকে এ সময় পারিবারিক খরচ পূরণ করতে হয় অথবা মাছ প্রক্রিয়াকরণ ইউনিটের মালিকদের কাছ থেকে অগ্রিম হিসাবে টাকা নিতে হয়।
কক্সবাজারের নাজিরাটেক গ্রামের শুকনো মাছ উৎপাদন শ্রমিক মমতাজ বলেন, আমি চলতি মৌসুমে টাকা পরিশোধের শর্তে গত বছর একটি শুটকি মাছ ইউনিটের মালিকের কাছ থেকে ৬ হাজার টাকা ধার করেছিলাম। আমি এখনো পুরো টাকা শোধ করতে পারিনি, কারণ আমার এখন কোন কাজ নেই।
স্বামী অসুস্থ হওয়ায় কাজ করতে অক্ষম বলে মমতাজ এবং তার ১২ বছরবয়সী ছেলে তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। তিনি শুটকি মাছের ইউনিটে কাজ করে দৈনিক আয় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা আয় করতে পারতেন।
কিন্তু,করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে নাজিরাটেক গ্রামে তাদের শুটকি মাছের খামারে গত দুই মাস ধরে কোন কাজ নেই। তাই, মমতাজ তার সঞ্চয় বা প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে পারিবারিক খরচ চালাচ্ছেন। তিনি ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব চিন্তিত, কারণ বর্ষাকালে তাদের কর্মহীন বসে থাকতে হয়। আর বর্তমানে তার হাতে কোন টাকাও নেই।
তিনি আরও বলেন, আমাকে আবার মাছের ইউনিটের মালিকদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিতে হবে, যদিও এটা পরবর্তী মৌসুমে আমার উপর একটা বিশাল বোঝা তৈরি করবে।
আরেকজন শুটকি শ্রমিক রেহানা আক্তার বলেন, আমি গত বছর শুটকি মাছের এক ইউনিটের মালিকের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা ধার নিয়েছিলাম। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আমাদের জীবিকার ওপর আঘাত এসেছে বলে আমি টাকা শোধ করতে পারিনি।
রেহানা দুই মাসের বেশী সময় ধরে কর্মহীন হয়ে বসে রয়েছে। কিন্তু তাকে তার পাঁচ নাবালক শিশুসন্তানের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়। তিনি বলেন, আমার স্বামী কয়েক বছর আগে হঠাৎ মারা গেছেন। আর আমার ছেলেমেয়েরা ছোট হওয়ায় উপার্জন করতে পারে না।
শ্রমিক মো. আলম বলেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে তার পাঁচ সদস্যের পরিবার আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে।
ব্যবসায়ীদের ব্যাপক ক্ষতি হবে:
নাজিরাটেক ড্রাই ফিশ ট্রেডার্স কো-অপারেটিভ সোসাইটির সভাপতি আতিকুল্লাহ সওদাগর বলেন, মৌসুমের শেষ কয়েক মাসে তারা বেশিরভাগ শুটকি মাছ উৎপাদন করেন।
তিনি বলেন, জেলেরা করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে সমুদ্রে যেতে ভয় পাচ্ছে বলে মাছের অভাবে চলতি বছর শুটকি মাছের উৎপাদন প্রায় শূন্যের পর্যায়ে নেমে এসেছে। আমরা চট্টগ্রাম থেকে মাছ আনতে গিয়ে পরিবহন সংকটের সম্মুখীন হয়েছি।
তিনি বলেন, নাজিরাটেক গ্রামে শুটকি মাছ ব্যবসায় গত মৌসুমে প্রায় ১০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।
আতিকুল্লাহ সওদাগর বলেন, নাজিরাটেক গ্রামে ১ হাজার ৪০টি শুটকি মাছ প্রক্রিয়াকরণ ইউনিটে প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক কাজ করে যার দুই-তৃতীয়াংশ নারী এবং তাদের অধিকাংশই দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করে।
ফাতেমা ফিশ সেলস সেন্টারের মালিক মো. ইমরানুল হক বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে শুটকি মাছের উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে গেছে।
প্রায় ১৫ থেকে ২০ জন লোক আমার ইউনিটে কাজ করে। তাদের মধ্যে আমি পুরো মৌসুমের জন্য মাত্র ছয়জন কর্মী ভাড়া করেছি। গত দুই মাসে কোন কাজ না থাকলেও আমাকে তাদের মজুরি দিতে হয়েছে।
হক বলেন, এই মৌসুমে ৫০ হাজার কেজি শুটকি মাছ সরবরাহের শর্তে এর আগে তিনি চট্টগ্রাম আসাদগঞ্জ বাজারের শুটকি মাছ ব্যবসায়ী একরাম অ্যান্ড ব্রাদার্সের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছিলেন। কিন্তু আমি টার্গেট পূরণ করতে না পারায় আমি ঋণের ফাঁদে পড়েছি।
একরাম এন্ড ব্রাদার্সের মালিক মো. শাহ একরাম বলেন, তিনি এ বছর ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন, কারণ উৎপাদকরা প্রত্যাশিত পরিমাণ শুটকি মাছ তাদের সরবরাহ করেনি।
তিনি জানান, লকডাউন থাকার কারণে, অধিকাংশ উৎপাদক মাছ সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছে। মৌসুম শেষ হওয়ার কারণে আমরা সম্ভবত উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবো না।
মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী শামস আফরোজ বলেন, ৪ শতাংশ হারে অ-ফসলী কৃষি উপ-খাতে ঋণ প্রদানের জন্য সরকার ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে।
শুটকি মাছ ব্যবসায়ী এবং উৎপাদনকারীরা প্রণোদনা প্যাকেজের সুবিধা নিতে পারেন। মৎস্য অধিদপ্তর এছাড়াও শুটকি মাছ শ্রমিকদের সহায়তা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে তিনি জানান।
শুটকি মাছ দেশের মানুষের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান। শুটকি মোট উৎপাদিত মাছের এক চতুর্থাংশ এবং ভোক্তাদের জন্য সবচেয়ে সহজলভ্য। লোকজন শুটকি খেতে পছন্দ করে বলে শুটকি মাছ দেশের অনেক অঞ্চলে খুব জনপ্রিয়।