করোনা পরিস্থিতিতে গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখতে বিশেষ উদ্যোগের ওপর জোর দিয়েছেন অর্থনীতিবিদগণ

357

॥ একেএম কামাল উদ্দিন চৌধুরী ॥
ঢাকা, ১০ জুন, ২০২০ (বাসস): কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ অর্থনীতিকে সচল রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগ আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের পরিধি বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদগণ।
বৈশি^ক মহামারী হিসেবে চিহ্নিত করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে সারাবিশ^ এখন অর্থনৈরতিক মন্দার কবলে। বাংলাদেশে মার্চের শুরুতে এর সংক্রমণ শুরু হলেও ইতিমধ্যেই সারাদেশে এর বিস্তার হয়েছে। বিশে^র অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষিকাজ ও গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক দুই গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন এবং ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখতে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের কার্যক্রম ও পরিধি বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন বলেন, আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই প্রকল্প করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সময়ে আরও অধিক কার্যকরি ভূমিকা রাখতে পারে।
তিনি বলেন, “করোনা ভাইরাস এর প্রাদুর্ভাবের কারণে শহরাঞ্চলের অনেক ভাসমান মানুষ গ্রামে চলে গেছে। এই গ্রামমুখী দরিদ্র মানুষকে আয়বর্ধক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করতে পারলে গ্রামীণ অর্থনীতির ব্যাপক উন্নয়ন হবে। এজন্য আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প ও আশ্রয়ণ প্রকল্প আরও সম্প্রসারণ করা উচিৎ,।”
তিনি দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূল ¯্রােতে আনার জন্য আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পটিকে আরও বৃহৎ পরিসরে সম্প্রসারণ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “প্রকল্পটির সঠিক বাস্তবায়ন দেশের দারিদ্র্যের হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে। প্রকল্পের লক্ষ্য অর্জনের জন্য, আমাদের সুবিধাভোগী বাছাই, সেবা প্রদান এবং পর্যবেক্ষণ কার্যক্রমের উপর বিশেষ জোর দিতে হবে।”
‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্প দেশের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অর্থনীতির মূল ধারায় যুক্ত করে তাদের জীবনমান উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন গতির সঞ্চার করেছে। সরকার এই প্রকল্পের আওতায় তহবিল সংগ্রহ করে এবং খামার গড়ে তোলার মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসনের পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের পরিচালক আকবর হোসেন বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকারের মূল লক্ষ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে এই প্রকল্প গ্রামীণ হতদরিদ্রদের স্বাবলম্বী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
তিনি জানান, প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত মোট ১ লাখ ১৭ হাজার ২০৪ টি গ্রাম উন্নয়ন সমিতি গঠন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ৫১ লাখ ২৭ হাজার ৮৫৮ টি পরিবারের প্রায় ২ কোটি ৫৬ লাখ দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিয়ে তাদের জীবনমান উন্নত করার প্রচেষ্ট চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রকল্পের সুবিধাভোগীরা ২০২০ সালের মে মাস পর্যন্ত প্রায় ১,৮৬৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা সঞ্চয় করেছে এবং সরকার এই সঞ্চয়ের সঙ্গে ১,৬১৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক বলেন, প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার দরিদ্র পরিবারগুলোকে পুঁজি গঠনে সহায়তা করছে, প্রশিক্ষণ এবং উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে তাদের দক্ষতা বাড়িয়ে তুলছে এবং উঠোন বৈঠকের মাধ্যমে তাদেরকে একত্রে বসার সুযোগ করে দিচ্ছে। এতে তাঁরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হচ্ছে এবং সেই সঙ্গে চাহিদাভিত্তিক ছোট-ছোট পারিবারিক খামার গড়ে তুলছে। প্রকল্পের আওতায় এসব খামারে উৎপাদিত পণ্য বিপণনের সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।
তিনি জানান, সরকার দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে গ্রামীণ অর্থনৈতিক কার্যক্রম ত্বরান্বিত করার জন্য প্রকল্পটি চালু করেছে। যাতে জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে বিশাল জনসংখ্যাকে মানব সম্পদে পরিণত করা যায়। তিনি বলেন, বর্তমানে সমিতির সদস্যরা আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছে এবং তাঁরা স্বাধীনভাবে নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য চালাতে সক্ষম হয়েছে।
এই প্রকল্পে সরকার নারীর ক্ষমতায়নে বিশেষ জোর দিচ্ছে। একেকটি গ্রাম উন্নয়ন সমিতির ৬০ সদস্যের ৪০ জন সদস্যই নারী। গ্রাম উন্নয়ন সমিতির প্রতিটি সদস্য প্রতিমাসে ২০০ টাকা করে সঞ্চয় করে এবং প্রতিমাসে সরকার তাদের সমপরিমাণ টাকা বোনাস দেয়। এই টাকা প্রকল্পাধীন পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে’র অ্যাকাউন্টে জমা রাখা হয়।
আকবর হোসেন জানান, সংশ্লিষ্ট সমিতির মাধ্যমে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক থেকে ঋণের টাকা পাওয়ার পর প্রতিটি গরীব পরিবারের সদস্যরা মৎস্য, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগির খামার, নার্সারি ও উদ্ভিজ্জ বাগান হিসাবে ছোট খামার গড়ে তোলে। ফলে, নিম্ন আয়ের মানুষের প্রতি ইঞ্চি ভূমি কৃষি উৎপাদনের জন্য দক্ষতার সাথে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তাদের খামারের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে সেই আয় থেকে প্রতিটি সদস্য সমিতির ঋণ পরিশোধ করে। এভাবে এই দরিদ্রদের দ্বারা গড়ে তোলা তহবিল স্থায়ীভাবে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।
আকবর হোসেন বলেন, এভাবেই এটি একটি দারিদ্র্য বিমোচনের চক্র হিসাবে কাজ করছে এবং এর মাধ্যমে দেশে দারিদ্র্যের চির অবসান ঘটবে।
একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প ২০০৯ সালে ১,৪৯২ কোটি টাকা নিয়ে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার জন্য শুরু হয়েছিল। প্রকল্পের সফলতা বিবেচনা করে ২০১৬ সালে প্রকল্পের বরাদ্দ ৮,০১০.২৭ কোটি টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে সংশোধিত প্রকল্প গৃহীত হয়।
বর্তমান সরকার ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে বর্তমান মেয়াদে সরকার গঠনের পর প্রকল্পের কার্যক্রমে গতিশীলতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়। গ্রামের হতদরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করে ’আমার বাড়ি আমার খামার’ করা হয়।