বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২ : অনলাইন টেইলারিং সার্ভিস জীবন বদলে দিয়েছে সাদিয়ার

415

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২
নারী উদ্যোক্তা-সাদিয়া
অনলাইন টেইলারিং সার্ভিস জীবন বদলে দিয়েছে সাদিয়ার
॥ মাহবুব আলম ॥
ঢাকা, ২৮ মে, ২০২০ (বাসস) : এমআইএসটি-তে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে (সিএসই) পড়া অবস্থায় ২০১০ সালে বিয়ে হয়ে যায় সাদিয়া ইসলামের। পরিবারের চাপ ছিল, সে পড়াশোনা শেষ করে আইটি খাতে উচ্চ বেতনে চাকরি করবে।
পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বাবা আমিনুল ইসলামও চাইতেন তার এই মেয়েটি প্রকৌশলী হোক। কিন্তু সে পথে পা মাড়াননি নারী উদ্যোক্তা সাদিয়া ইসলাম।
অনলাইনে ‘টেইলারিং সার্ভিস’-এর ব্যবসা চালু করে তিনি পুরো পরিবারকেই যেন চিন্তায় ফেলে দিলেন। পরিবারের সবার ‘না’। কিন্তু, সাদিয়ার জেদ-নিত্যনতুন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নতুন পথেই শুরু করবেন ব্যবসা।
তবে, এর আগেই সাদিয়া ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেন। অনলাইনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজ করে বেশ আয়ও করেন তিনি। ঘর সামলানোর পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিংও বেশ ভালোই চলছিল। কিন্তু মাথায় ঘুরছিল অন্যকিছু।
প্রতিদিনই এক ধরনের কাজ করতে গিয়ে রীতিমতো হাঁপিয়ে ওঠেন সাদিয়া। নতুন কিছু করা যায় কিনা-তা নিয়ে চলছিল তার চিন্তা-ভাবনা। তা অবশ্যই হতে হবে ইউনিক কিছু। এরই মধ্যে তিনি একজন ডিজাইনার হিসেবেও নাম কুড়িয়েছেন।
এবার তার পাশে এসে দাঁড়ালেন স্বামী প্রকৌশলী কামরুল হাসান। স্ত্রীর অনলাইনে টেইলারিং সার্ভিস আইডিয়াটাকে ভীষণ উৎসাহ দিলেন কামরুল হাসান। তার সহযোগিতায় ৫০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু করলেন অনলাইন টেইলারিং সার্ভিস ‘স্টাইল ক্যানভাস’। সেটা ২০১৫ সালের কথা। কিন্তু সাদিয়ার বাবা প্রথমে সেভাবে এই উদ্যোগে সায় দিলেন না। তবে, সাদিয়ার যুক্তি ছিল, নতুন কিছু করতে পারলে মন্দ কী!
সম্প্রতি এক আলাপচারিতায় উদ্যোক্তা সাদিয়া জানালেন, যেহেতু সময়টা তথ্যপ্রযুক্তির। ডিজিটাল বাংলাদেশের সব সুবিধা মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে। কত কাজই তো অনলাইনে করছে মানুষ। ‘টেইলারিং’ কেন নয়? অ্যানালগ পদ্ধতিতে যুগ যুগ ধরে চলছে, তবে, এটাকে অনলাইনে মানুষ কীভাবে নেয়, এ নিয়ে একটা দুঃচিন্তা ছিল।
শুরুর দিনগুলোর কথা তুলে ধরে নারী উদ্যোক্তা সাদিয়া বললেন, প্রথমে ফেসবুক একটি পেজ খুললাম। স্বপ্নের এ উদ্যোগের নাম দিলাম ‘স্টাইল ক্যানভাস’।
‘শুরুতে নিজের ডিজাইন করা ছোট বাচ্চাদের পোশাক তৈরি করতে লাগলাম। সাড়াও পেলাম বেশ। অর্ডার আসতে শুরু করলো। কারখানা বলতে একটি মেশিন। অফিস বাসাতেই। কর্মী তিনজন, এর মধ্যে একজন টেইলর মাস্টার, একজন সুইংম্যান এবং একজন ডেলিভারি ম্যান।’
তিনি বলেন, ক্রেতা অর্ডার দিলে মাস্টার বাসায় গিয়ে মাপ নিয়ে আসেন। আর সুইংম্যান সেলাই করেন এবং ড্রেস হয়ে গেলে ডেলিভারিম্যান তা বাসায় গিয়ে পৌঁছে দেন।
আর এভাবেই পরিকল্পনা থেকে বাস্তবে রূপ নেয় তরুণ উদ্যোক্তা সাদিয়ার স্বপ্ন। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করলেন কীভাবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যেহেতু নতুন উদ্যোগ। তাই, প্রথমে ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে এবং পেজে নিজের উদ্যোগের কথা জানাই। সবাই বেশ ভালোভাবে গ্রহণ করে। কারণ, এটি তখনও কেউ সেভাবে চালু করেনি।
‘এরপর অনলাইনে অর্ডার বাড়তেই থাকে। ফোনেও আসতে থাকে ক্রেতার অর্ডার। ডোর টু ডোর সুইং সার্ভিস এবং ফ্রি হোম ডেলিভারি। এভাবে ক্রেতা বাড়তে থাকে। এই মুহূর্তে ৩শ’র মতো রেজিস্ট্রার্ড ক্রেতা রয়েছেন। যাদের সবই নারী।’
সাদিয়া বলেন, প্রথমে শুধু তৈরি করলেও এখন পোশাক টেইলারিং, অলটারেশন, এমব্রয়ডারি, রেডিমেড ড্রেস মাপ নেয়া, তৈরি করা এবং বাড়িতে গিয়ে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছি আমরা।

এ অবস্থায় ২০১৬ সালে লোকবল বাড়ানো হয়। যুক্ত হয় আরো তিনজন কর্মী। তিনি বলেন, সুদক্ষ কর্মী বাহিনীর সঙ্গে সেবার অনন্য মনোভাব নিয়ে আমরা কাজ করছি। ফলে, অতি প্রাচীন একটি ট্রেন্ডকে নতুনভাবে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছি। যা মানুষও গ্রহণ করেছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে সাদিয়া বলেন, প্রথম প্রথম আমার এলাকা মোহাম্মদপুরের ক্রেতারাই বেশি অর্ডার দিতেন। দূরের ক্রেতারা অর্ডার দিলেও তা করতে পারতাম না। কিন্তু এখন প্রায় পুরো ঢাকা শহরে এ সেবা দিচ্ছি আমরা।
‘নিজ গ্রুপে ও ফেসবুক রেফারেন্সে ধীরে ধীরে ক্রেতা বেড়েছে। এখন ধানমন্ডি, উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, গুলশান, বনানীসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে কাজের অর্ডার পাই,’ যোগ করেন তিনি।
কীভাবে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়? এ বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা মূলত অনলাইনে অর্ডার নিই। সপ্তাহে দুটি ছুটির দিন অর্থাৎ শুক্র ও শনিবার কর্মজীবী, করপোরেট নারীরা কিংবা ব্যস্ত গৃহিণীদের দেওয়া সময় অনুযায়ী আমাদের টেইলর মাস্টার চলে যান মাপ নিতে তাদের বাসায়। তারপর শুরু হয় মেকিংয়ের পালা। ড্রেস তৈরি করার পর কাস্টমারের কনভেনিয়েন্ট টাইমে ডেলিভারিম্যান তা পৌঁছে দেন ক্রেতার বাসায়।
সাদিয়া জানান, বর্তমানে মাসে দেড় লাখ টাকার অর্ডার আসে তার। তার ভাষ্যমতে, পয়লা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, পয়লা ফাল্গুন, ১৬ ডিসেম্বর, ঈদ, পূজা সব উৎসবে ও বিশেষ দিনে নিজস্ব ডিজাইনে পণ্য তৈরি করা হয়। পরে তা ফেসবুকে ‘স্টাইল ক্যানভাস’ এর পেজে আপলোড করা হয়। সেখান থেকে বিক্রিও হয়। আবার আমরাও ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী পোশাক তৈরি করে দিই। বর্তমানে আমার ‘স্টাইল ক্যানভাসে’ প্রায় ১৫ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। ভবিষ্যতে তা আরও বড় করার পরিকল্পনা রয়েছে, বলেন সাদিয়া।
নতুনদের উদ্দেশ্যে উদ্যোক্তা সাদিয় বলেন, আমি মূলত একজন প্রকৌশলী। চাইলে হয়তো দেশি-বিদেশি কোনো কোম্পানিতে ভালো বেতনে চাকরি করতে পারতাম। কিন্তু নিজের স্বাধীনতাটুকু পেতাম না।
‘তাই শত কষ্টের মধ্যেই নিজে কিছু করার চেষ্টা করেছি; যেখানে নিজের ভালো লাগা আর স্বাধীনতার মূল্যায়ন পাওয়া যাবে, পরিবারকেও সময় দিতে পারবো। আমি শুধু লেগে ছিলাম আর একমনে কাজটা করে গেছি। নতুনদের বলবো- আপনারা সৎভাবে লেগে থাকুন। দেখবেন সফলতা আসবে।’
মাত্র একটি সেলাই মেশিন আর ৫০ হাজার টাকার পুঁজি দিয়ে শুরু- সেখান থেকে দৃঢ় মনোবল এবং নতুন কিছু করার প্রত্যয়ে আজ সফল একজন নারী উদ্যোক্তা সাদিয়া ইসলাম। একজন স্বাবলম্বী নারী। বর্তমানে তার ব্যবসার মূলধন প্রায় ১৫ লাখ টাকা। অন্য নারীদের আইকনেও পরিণত হয়েছেন তিনি।
বর্তমানে নতুন উদ্যোক্তা গড়ে তোলার লক্ষে ১৪টি ট্রেডের ওপর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এসএমই ফাউন্ডেশন। এ বিষয়ে ফাউন্ডেশনের পরিচালক ইসমত জেরিন খান বলেন, উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসা ব্যবস্থাপনা, প্রজেক্ট প্রপোজাল তৈরি, ফ্যাশন ডিজাইনিং, বহুমুখী পাটজাত দ্রব্য, পাট উৎপাদন, ড্রাই ফ্লাওয়ার তৈরি, থাই ক্লে দিয়ে শো পিস তৈরি, আর্টিফিয়াল জুয়েলারি, চামড়াজাত পণ্য তৈরি, ফাস্টফুড তৈরি ও সংরক্ষণ, ব্লক-বাটিক ও স্ক্রিন প্রিন্ট, ন্যাচারাল ডাইং, বিউটিফিকেশন ও পার্লার ব্যবস্থাপনা এবং নতুন ব্যবসা শুরু বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
দক্ষতা বাড়ানোর জন্য নতুনরা এসব প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারেন বলে মনে করেন নারী উদ্যোক্তা সাদিয়া।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/মাআ/আরজি/১০১০/এসএইচ