বাসস ইউনিসেফ ফিচার-৩ : ঈশ্বরগঞ্জের ‘মৎস্যকন্যা’ খায়রুনের উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প

128

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-৩
উদ্যোক্তা-খায়রুন
ঈশ্বরগঞ্জের ‘মৎস্যকন্যা’ খায়রুনের উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প
॥ মাহবুব আলম ॥
ঢাকা, ২৭ মে, ২০২০ (বাসস) : আর পাঁচজন গৃহবধূর মতো ঘরকন্না নিয়েই দিন কাটছিল তার। কিন্তু স্বামীর ব্যবসার লোকসানই যেন তাকে নতুন করে সংগ্রামী ও উদ্যমী হতে শিখিয়েছে। এখন তিনি মৎস্য খামারের গর্বিত মালিক। এলাকায় এখন তার পরিচিতি ‘মৎস্যকন্যা’ নামে।
বলছি, মহুয়া-মলুয়ার জেলা ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের আঠারবাড়ী ইউনিয়নের মহেচ্ছাতুল গ্রামের খায়রুন নাহারের কথা। কৃষিখাতে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৫ সালে তিনি পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার।
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ শহরের বাড়িতে বসে খায়রুন গল্পের মতো বলছিলেন নিজের সংগ্রামের কথা, উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার পেছনের গল্প।
বিয়ের দশ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও সন্তানাদি হয়নি। এ নিয়ে একটু কষ্ট তো রয়েছেই। এর মাঝে স্বামী আবুল কালাম আজাদ মাছ চাষ করতে গিয়ে বড় রকমের ধরা খেলেন। এরপর অনেকটা মুষড়ে পড়লেও পুনরায় ইচ্ছাশক্তির বদৌলতে স্বামীর পাশে দাাঁড়ান খায়রুন।
খায়রুন বলেন, এখন প্রতিষ্ঠিত। এটা নিয়েই মানুষ আলোচনা করে। কিন্তু যখন স্বামী মাছ ব্যবসায় লোকসান খেলেন তখন মানুষের কটুক্তিও কম শুনতে হয়নি।
‘কিন্তু সাহস সঞ্চয় করে স্বামীর সঙ্গে আলাপ করলাম কীভাবে ঘুরে দাঁড়ানো যায়? কিন্তু কিছু একটা করতে গেলে তো পুঁজি লাগবে-তা পাবো কোথায়? এর মাঝে বাবার বাড়ি ও শ্বশুর বাড়ি থেকে লাখ খানেক টাকা ধার-দেনা করে স্বামীর হাতে দিলাম। সঙ্গে আমিও তাকে সহযোগিতা করতে লাগলাম। এর মাঝে আমি সোনালী ব্যাংকের ঋণের কথা শুনি। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শুরু করি মাছ চাষ। এরপর একবছর পর লাভের মুখ দেখতে শুরু করি।’
খায়রুনের মতে, মা চাষ করায় এখন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এখন আমাদের চেনে। কিন্তু এই অবস্থায় আসাটা খুব সহজ ছিল না। রাতকে দিন করে অমানুষিক পরিশ্রম রয়েছে। নারী হয়ে দিন-রাত খামারে কাজ করছি- এ নিয়ে সমাজের মানুষও ভালো চোখে দেখেনি। তবে, আমি লোকের মন্দকে গলার হার করেই নিজের কাজটা করে গেছি।
শুরুর দিকের কথা বলতে গিয়ে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এই উদ্যোক্তা বলেন, ২০১২ সালে এক লাখ টাকা দিয়ে প্রথমে রেণু পোনা উৎপাদন শুরু করি। তখন পুকুরও কম ছিল- নিজের একটা আর লিজ নেওয়া তিনটা।
‘তবে প্রথম ছয় মাসে তেমন ভালো মুনাফা আসেনি। কিন্তু তাতে হাল ছেড়ে দেইনি। ততদিনে অনেক ধার-দেনাও হয়ে গেছে। স্বামীর আগেরও কিছু ঋণ ছিল। তবে, ভেঙে পড়িনি। আবারও ধার-কর্জ করা টাকা দিয়েই পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষ শুরু করি।’
খায়রুন বলেন, বছরখানেক পরে অর্থাৎ ২০১৩ সালে অনেকেই বললেন-নারীদের নাকি ব্যাংক ঋণ দেয়। আমিও খোঁজ-খবর নিয়ে ঈশ্বরগঞ্জের সোনালী ব্যাংকের শাখায় ঋণের জন্য আবেদন করি। নারী উদ্যোক্তা হিসেবে আমি ৪ লাখ টাকা পাই।
‘মাছ চাষের জন্য এটা একটা মোটামুটি পুঁজি। এর মাঝে মাছ এবং পোনা বিক্রির টাকা থেকে আগের ঋণও পরিশোধ করি। এরপর শুরু আমাদের নতুন জীবন, ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম।’
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এবার আনন্দের অশ্রুসিক্ত হাস্যোজ্জল মুখে খায়রুনের ভাষ্য, আমার সাফল্যে পরিবার এবং সমাজের লোকজনও খুশি। এবার সবাই আমাদের নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। সাফল্য দেখে সোনালী ব্যাংক আরও ৮ লাখ টাকা ঋণ দেয়।
এ পর্যায়ে পুকুরের সংখ্যা চার থেকে বাড়িয়ে ১১টিতে উন্নীত হয়। খামার এলাকার আয়তন এখন ১৭ একর। খামারের নাম ‘সৃষ্টি ফেয়ার মৎস্য হ্যাচারি’। মাছ উৎপাদনে খায়রুনের খামারের খবর ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে ঈশ্বরগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ জেলাজুড়ে। এমনকি অন্যান্য জেলা থেকেও তার খামারে পোনা নিতে ছুটে আসেন ব্যাপারীরা।
এরই মাঝে নিজের একাগ্র আর পরিশ্রমের স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি। ২০১৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন ‘মৎস্যকন্যা’ খায়রুন।
জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্র জানায়, ময়মনসিংহে দেশের মোট মাছ উৎপাদনের ১১ শতাংশ উৎপাদন হয়। আর পাঙ্গাশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৫০ ভাগই হয় এ অঞ্চলে।
জেলার ত্রিশাল, ফুলপুর, ফুলবাড়ীয়া, গফরগাঁও, গৌরীপুর ও ভালুকায় মাছের খামারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হলেও এখন ঈশ্বরগঞ্জেও খায়রুনের দেখাদেখি কিছু বাণিজ্যিক খামার গড়ে উঠছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ময়মনসিংহ জেলায় সাড়ে চার লাখ টনের বেশি মাছ উৎপাদন হয়েছে; যা জেলার চাহিদার চেয়ে প্রায় চারগুণ বেশি।
বর্তমানে খায়রুন-আজাদ দম্পতির খামারে রুই, কাতলা, মৃগেল, গ্রাস কার্প, তেলাপিয়া, পাঙ্গাস, শিং, মাগুর, গুলশা মাছের চাষ হয়। পাশাপাশি রেণু পোনা উৎপাদনও অব্যাহত রয়েছে।
চলতি মৌসুমে তার প্রকল্পে উৎপাদিত মাছ ও পোনা বিক্রির পরিমাণ ১ কোটি টাকার বেশি বলে জানিয়েছেন খায়রুন। ভবিষ্যতে মাছ চাষের পাশাপাশি ঈশ্বরগঞ্জসহ আশপাশে বিদ্যুৎ নেই এমন এলাকায় তিনি বড় আকারের সৌরবিদ্যুৎচালিত সেচ প্রকল্প চালুর পরিকল্পনা করছেন।
এ বিষয়ে খায়রুনের ভাষ্য, এটা করতে পারলে কৃষি উৎপাদনে গ্রামীণ জনজীবনে নবদিগন্তের সূচনা হবে।
একই সঙ্গে গ্রামীণ নারীদের সংগঠিত করে ‘একটি বাড়ি, একটি খামার’ প্রকল্পে সম্পৃক্ত হতেও উৎসাহিত করছেন বলেও জানান তিনি।
খায়রুনের স্বামী আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমি যেখানে ব্যর্থ হই, সেখান থেকে আবারও করে খায়রুন। এখন আমরা সফল। এলাকার অনেক বেকারের কর্মসংস্থান হয়েছে আমাদের এ খামারে। এখন অবশ্যই নিজেকে গর্বিত মনে হয়।
মাছ চাষে খায়রুনের সাফল্যে আনন্দিত সরকারি কর্মকর্তারাও। ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা এএসএম সানোয়ার রাসেল বলেন, পরিশ্রম যে সাফল্যের চাবিকাঠি-সফল নারী উদ্যোক্তা খায়রুন তা করে দেখিয়েছেন। তাকে দেখে এলাকার অনেকেই আইডল হিসেবে মানছেন। আমরাও তাকে সব ধরনের সহযোগিতা করে থাকি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাকির হোসেন বলেন, খায়রুন নাহার যেভাবে পরিশ্রম ও একাগ্রচিত্তে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন তা নারীদের জন্য অনুকরণীয়। কর্মফল হিসেবে তিনি জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কৃতও হয়েছেন। এটি নারীদের জন্য গর্বের। তাকে দেখে নারীরা উদ্বুদ্ধ হলে মাছ চাষে বিপ্লব ঘটবে।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/মাআ/আরজি/আহো/১৮০৩/এসএইচ