আম্পানের ছোবল থেকেও ফের বুক পেতে দিয়ে রক্ষা করল সুন্দরবন

404

\ মো. শাহ আলম টুকু \
বাগেরহাট, ২৩ মে, ২০২০ (বাসস) : বারবার নিজে ক্ষত-বিক্ষত হয়েও বুকপেতে দিয়ে উপকূলবাসীকে রক্ষা করে যাচ্ছে সুন্দরবন। এবারো সুপার সাইক্লোন আম্পানের প্রলংকরী ছোবলের গতিকে থমকে দিয়ে ভয়ঙ্কর ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করল কোটি মানুষের জান-মাল। এতে সুন্দরবনও হয়েছে ক্ষতবিক্ষত। ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড সুন্দরবন শুধু বিশে^ জীববৈচিত্রের বৃহত্তম আধারই নয়, এটি আমাদের রক্ষাকবজও।
বিশে^র সবচেয়ে বড় এ শ^াসমূলীয় বনটি ঘূর্ণিঝড় আম্পানের গতি উপকূলে আঘাত আনার আগে বুকপেতে দিয়ে গতিবেগ ৭০ কিলোমিটার কমিয়ে দেয়। সুন্দরবন জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতাও কমিছে ৩ থেকে ৪ ফুট।
ফলে, উপকূলবাসীর জান-মালের ক্ষতির পরিমাণ কমেছে অনেক। ঝড়টি ঘন্টায় ১৫৫ থেকে ১৬৫ কিলোমিটার গতিতে আঘাত করার কথা থাকলেও সুন্দরবন ঝড়ের গতি থমকে দেয়ায় সাতক্ষীরায় আঘাত হানে ১৫১ কিলোমিটার গতিবেগে। অথচ পশ্চিমবঙ্গে ঝড়টি ঘন্টায় ১৫৫ থেকে ১৬৫ কিলোমিটার গতিবেগে আঘাত হানে। ঝড়ের গতি থমকে দিতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সুন্দরবন।
তবে, এই প্রথম নয় গত দেড়শ’ বছরে ৭৫টি প্রলংকারী ঘূর্ণিঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে যায় সুন্দরবন। তারপরও সুন্দরবন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ১৯৮৮ ও ১৯৯৭ সালের ঘূর্ণিঝড়, ২০০৭ সালের সিডর, ২০০৯ সালে আইলা ২০০৯ সালে রোয়ানু, ২০১৮ সালে বুলবুল, ২০১৭ সালে ফনীর আঘাত থমকে দেয় সুন্দরবনকে। ২০১৮ সালে চট্রগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঘুর্ণিঝড় সিডর এর সময় বুক দিয়ে আগলে রেখে ঝড়ের গতিবেগ কমিয়ে দিয়ে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ৪৮৫ দশমিক ২৯ মিলিয়ন ডলারের সম্পদ বাঁচিয়েছিল সুন্দরবন।
বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, বনবিভাগের প্রাথমিক হিসাব অনুয়ায়ী সুন্দরবনের মিষ্টি পনির উৎস ৬৫টি পুকুর, বনবিভাগের ১৮টি টিনের তৈরী ফাঁড়ি ২৮টি জেটিসহ অন্যান্য অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেওড়াসহ অসংখ্য বনজ গাছ ভেঙ্গে পড়েছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যসহ অবকাঠামোসহ ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত অবস্থা জানতে ৪টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খুলনা ও সাতক্ষীরা এলাকার। ৪টি রেঞ্জের এসিএফদের প্রধান করে ৭ সদস্য বিশিষ্ট এসব কমিটিকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে সরেজমিনে সুন্দরবনের প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। রিপোর্ট পেলে সুন্দরবনের প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির তথ্য জানা যাবে।
তিনি আরো বলেন উদ্বিগ্ন হবার কোন কারণ নেই। সুন্দরবনকে তার মতো করে থাকতে দিলে আগামী ৬ মাসের মধ্যে এই বনটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। বনের মধ্যে যেসব পুকুরে লবন পানি ঢুকে পড়েছে, এসব পুকুর থেকে বনবিভাগের কমী, বাঘ, হরিণ বানরসহ অন্যান্য বন্য প্রাণীরা খাবার পানি খায়। মিঠা পানির পুকুরগুলোতে জলোচ্ছ্বাসে ভরে যাওয়া লবন পানি দ্রুত পাম্প করে অপসারণের কাজ শুরু হবে।
সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম জানান, এই সংরক্ষিত বনে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার পরে প্রকৃত অবস্থা নিয়ে উদগ্রীব লক্ষ-কোটি মানুষ। সুন্দরবনকে তার মতো করে থাকতে দিলে আগামী ৫ থেকে ৬ মাসের মধ্যে এই বনটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। প্রাণ ফিরে পাবে সুন্দরবন। নিকট অতীতেও সুন্দরবন সাইক্লোন সিডর, আইলা, বুলবুলের ক্ষত কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবারই ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে সুন্দরবন উপকূলের কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করে চলেছে। সুন্দর বনকে রক্ষার জন্য সুন্দরবনের সব বন অফিসের ভবন ও জেটি ঘূর্ণিঝড় সহনীয় করে নির্মাণ, আগুনের হাত থেকে সুন্দরবনকে রক্ষায় এই বনের জন্য নিজস্ব ভাসমান অগ্নির্নিবাপক নৌযান ক্রয়, বনের লোকালয় সন্নিহিত এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ, জেলে-বনজীবীদের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ, বন্যপ্রাণীর খাবারের মিঠা পানির জন্য পর্যাপ্ত পুকুর খননসহ সুন্দরবন সুরক্ষার দাবি জানান এই পরিবেশবিদ।
সংরক্ষিত এই বনের ৩টি এলাকাকে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ইউনেস্কো ৭৯৮তম ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইড ঘোষণা করে। যা সমগ্র সুন্দরবনের ৩০ ভাগ এলাকা। সুন্দরী, গেওয়া, গরান, পশুরসহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে সুন্দরবনে। এছাড়া ৩৭৫ প্রজাতির বন্য প্রাণীর মধ্যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও হরিণসহ ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, লোনা পানির কুমির, গুইসাপ, কচ্ছপ, ডলফিন, অজগর, কিংকোবরাসহ ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৩১৫ প্রজাতির পাখি রয়েছে। ইতিধ্যেই সুন্দরবন থেকে হারিয়ে গেছে এক প্রজাতির বন্য মহিষ, দুই প্রজাতির হরিণ, দুই প্রজাতির গন্ডার, এক প্রজাতির মিঠা পানির কুমির।
গোটা সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জর ১৮টি রাজস্ব অফিস, ৫৬টি টহল ফাঁড়ি রয়েছে। অপ্রতুল জনবল দিয়ে বিশাল এই সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতিকে দেখভাল করা একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ। সুন্দরবন ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সাইডের পাশাপাশি বিশে^র বৃহৎ জলাভূমিও। সুন্দরবনের জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ দশমিক ১ বর্গ কিলোমিটার। যা সমগ্র সুন্দরবনের ৩১ দশমিক ১৫ ভাগ। ১৯৯২ সালে সমগ্র সুন্দরবনের এই জলভাগকে রামসার এলাকা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ।