বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১ : গ্রাম পর্যায়ে সেবা দিচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক

146

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১
সেবা-কমিউনিটি ক্লিনিক
গ্রাম পর্যায়ে সেবা দিচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক
ঢাকা, ২৩ মে, ২০২০ (বাসস) : বাড়ির ছোট একটা রুমে পরিবার নিয়ে থাকেন রানু। ঘরের এক কোনে ছোট একটা চৌকি। সেখানে বসে পা ঝুলিয়ে রানু মেয়ের ছোট ছোট কাপড় ভাজ করে ঝুড়িতে রাখছেন। পাশে বসে রহমত মিয়া পাখা দিয়ে বাতাস নিতে নিতে শিশুর টিকার কাগজগুলো উল্টে পাল্টে দেখছে।
কাপড় রেখে রানু উঠে এসে টিকার দিন তারিখ গণনা করে দেখল। আর একটা টিকা দিলেই তার মেয়ের পুরো ডোজ শেষ হবে। তারা দুজনেই শিশুর ব্যাপারে খুব সচেতন। অন্ত:সত্বা হওয়ার পর থেকেই নিয়মিত কমিউনিটি ক্লিনিকের ‘ডাক্তার আপার’(মহিলা ডাক্তার) কাছে যায়। গর্ভকালীন স্বাস্থ্য সেবা থেকে শুরু করে প্রসব পরবর্তী সব সময় নিয়মন মেনে চলতে ভুল করেনি নি¤œ মধ্যবিত্ত পরিবারের এই জুটি। মা ও শিশু দুজনকে সুস্থ রাখতে সব সময় সতর্ক থেকেছে শৈলকুপা উপজেলার বারইপাড়া গ্রামের মুদি দোকানের মালিক রহমত।
রানুকে দেখে গ্রামের অনেকে স্বাস্থ্য সচেতন হয়েছে। তাদেরই একজন পারুল। বয়স ২১ কিংবা ২২ বছর। গর্ভধারণের পর থেকেই মায়ের বাড়িতে আছেন পারুল । বাড়ির পাশে স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে সেবা নিতে সুবিধা বলেই তার শশুর বাড়ি থেকে এ সিদ্ধান্ত নেয়। ফুটফুটে শিশু রেদোয়ানকে নিয়ে তাদের খুশির সীমা নেই। বারান্দার এক কোনে রোদে মাদুর পেতে বাচ্চাকে শাড়ির আঁচলে ঢেকে বুকের দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে পারুল শিশুর জন্মের কথা ভাবতেই তার স্মৃতিতে ভেসে ওঠে কয়েকমাস আগের কথা। সে তখন ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। শরীরটা ভাল যাচ্ছেনা। হাত পা ফুলে যাচ্ছে। শরীর ঝিমঝিম করে, দূর্বল লাগে। উপেজলা হাসপাতালে ডাক্তারের কাছে ছুটে গেলে পারুলের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে কিছু শারিরিক সমস্যা ধরা পড়ে। ডাক্তারের পরামর্শ মেনে পারুল সুস্থ হয়ে ওঠে এবং সুস্থভাবে জন্ম জন্ম দেন রেদোয়ানের। স্বাস্থ্য সচেতন পারুল নিজের ও সন্তানের দিকে নজর রাখে, যতœ নেয়। নিয়মিত কমিউনিটি ক্লিনিকে নিয়ে শিশুকে টিকা দেয়া ও গর্ভ পরবর্তী চেকআপ করতে ভুল করেন না।
তবে রানু-পারুলদের মত আমাদের দেশের সব মায়েরাই এতটা স্বাস্থ্য সচেতন নয়। লাইলি বানুর কথাই ধরা যাক, তার এক বছরের শিশুর প্রচন্ড ঠান্ডা নিয়ে পান্টি কমিউনিটি ক্লিনিকে নিয়ে এসেছেন। শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট দেখে কর্তব্যরত ডাক্তার দ্রুত কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনে লাইলির মাথায় বাজ পড়ে। তবে ডাক্তার তাকে আশ্বস্ত করে বলেন সুস্থ হতে বেশ সময় লাগলেও তেমন জটিল না। নিয়ম মাফিক ওষুধ খাওয়ালে ও যতœ করলে ঠিক হয়ে যাবে, ভয়ের কিছু নেই। ডাক্তারের কথায় প্রাণ ফিরে পায় লাইলি।
গ্রামাঞ্চলে বাল্যবিবাহ ও ঘন ঘন সন্তন জন্মদানের কারণে মেয়েদের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। ফলে মারাত্মক অসুস্থতার কারণে মাতৃ মৃত্যুর মতো বেদনাদায়ক অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। তাই প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে নজর দেওয়া প্রয়োজন। এ সম্পের্ক ঝিনাইদহ শহরের একটি প্রাইভেট ক্লিনিকের পরিচালক ফরিদা পারভীন পাখি জানান, স্বাস্থ্য সচেতনতা মানুষকে অনেক বড় বিপদ থেকে রেহাই দিতে পারে। সময় মত ডাক্তারের পরামর্শ নিলে সুস্থ জীবন যাপন সম্ভব। এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকিও কমিয়ে দেয়। তাই প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার বিষয়গুলোর প্রতি সবার গুরুত্ব দেয়া জরুরি। ডাক্তার বলেন, নারীদের ক্যালসিয়াম ঘাটতি, হরমোন সমস্যাসহ নানা রোগ হয়ে থাকে। কিন্তু তারা আনেকেই এর কোন চিকিৎসা করান না। তাছাড়া অপরিষ্কার থাকার কারণে মহিলাদের জরায়ুতে ইনফেকশন হয়। ময়লা কাপড় ব্যবহারের কারণে হাত-পায়ে চুলকানি হয়। নবজাতক শিশুর পাতলা পায়খানাসহ নানা অসুখ বিসুখ দেখা দেয়। আবার পানিবাহিত নানা রোগ যেমন ডায়রিয়া, জন্ডিসের মত জটিল রোগ জীবনকে বিপর্যস্ত করে। তাই পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকার বিকল্প নেই।
রাজধানী ঢাকার শিশু হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. কামরুল হাসান বলেন সরকার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারী-শিশু স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেয়ার সর্বোচ্চ চেস্টা করছে। তিনি বলেন,‘ তবে সবাই একটু সচেতন হলেই সুস্থ জীবন যাপন সম্ভব।’
হাসান বলেন বিশেষ করে সন্তানদের বিষয়ে তাদের মায়েদের সচেতন হতে হবে। নতুবা শিশুরা ভাইরাস কিংবা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। তা ছাড়া বাচ্চাদের কোন ধরনের খাদ্য দিতে হবে সে বিসয়েও মায়েদের জানতে হবে।
কারণ শিশুর পরিচর্যা, সঠিক পুষ্টি, সময়মতো টিকা দেয়া ইত্যাদি কাজ এখনও আমাদের দেশে মায়েদেরকে দেখতে হয়। মায়েরা স্বাস্থ্য সচেতন না হলে সন্তান নিউমোনিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হতে পারে। আবার কোন বয়সের শিশুকে কি ধরনের পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে তাও মায়েদের জানা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, সরকারের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বিনা খরচে প্রতিটি দোরগোড়া পর্যস্ত মানসম্মত সেবা পৌঁছে দিতে সারাক্ষণ কাজ করছেন।
হাসান বলেন সরকারের কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম সাধারন মানুষের মধ্যে ব্যপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বর্তমানে গ্রামের ৮০ শতাংশ লোক এসব ক্লিনিকে বিনা খরচে সেবা নিতে আসেন। বাচ্চাদের ওজন মাপা, ভিটামিন ক্যাসুল খাওয়ানো, ডায়াবেটিস ও প্রেসার মাপাসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকজনকে বিভিন্ প্রকার সেবা দিচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক।
পাশাপাশি সিভিল সার্জন অফিস থেকেও ক্লিনিকের কার্যক্রম নিয়মিত তদারক করা হয়। এছাড়া কোনো ক্লিনিকের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ উঠলে দ্রুত ব্যাবস্থাও নিয়ে থাকে কর্তৃপক্ষ। প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে একজন স্বাস্থ্য সহকারী ও পরিবার কল্যান সহকারী থাকেন, এেেদও মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের লোকজন স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছে। যার ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বাস্থ্য সেবার চিত্রই বদলে গেছে।
সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত এ সব ক্লিনিকে প্রতিদিন গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ মানুষ সেবা পাচ্ছে। এখান থেকে রোগীদের প্রয়োজনীয় ত্রিশ ধরনের ওষুধ দেয়া বিনা পয়সায়।
সরকারের এই জনস্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম ইতোমধ্যেই জাতিসংঘ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংকসহ বহির্বিশ্বে বিপুল প্রশংসা কুড়িয়েছে। একই সঙ্গে তারা দেশে রোগ নির্ণয়সহ আনুষঙ্গিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সর্বাধুনিক প্যাথল্যাব প্রতিষ্ঠাসহ দক্ষ জনবল গড়ে তোলার ওপর যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করেছে।
এই কর্মসুচির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ প্রথমবার ক্ষমতায় এসে ১৯৯৬-২০০১ সময় কালে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প শুরু করে। তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা পেীৗঁছে দিতে সে সময় আঠারো হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করে।
জনগণের কাছে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দিতে প্রকল্পের অধীনে এ পর্যন্ত ১৩ হাজার ৮শত ১২টি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ার পাটগাতিতে ২০০০ সালের ২৬ এপ্রিল প্রথম কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্বোধন করেন।
ঐ কর্মকর্তা জানান এসব ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করতে স্থানীয় জনগণ প্রায় আটশ একর জমি দান করেছেন। এসব ক্লিনিকে সরকার সরকার ১৩ হাজার ৭৮৪ জন স্বাস্থ্য কর্মী নিয়োগ দিয়েছেন এবং প্রতিটি ক্লিনিকে ওষুধ বাবদ বছরে এক লাখ দশ হাজার বরাদ্দ দিচ্ছে।
দেশের তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের কাছে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ২০২২ সালের মধ্যে সরকার আরো চার হাজার ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে- উল্লেখ করেন কর্মকর্তারা।
আরো আশার কথা হচ্ছে সরকার কমিউনিটি ক্লিনিক কর্মীদের চাকরি স্থায়ীকরণসহ বেতন বৃদ্ধি, পদোন্নতির সুযোগ, গ্র্যাচুইটি ও অবসর ভাতার বিষয়গুলো সক্রিয় বিবেচনা করছেন।
বাসস/ ইউনিসেফ ফিচার/এসপি/আহো/১০০০/-স্বব