বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২ : দারিদ্র্য বিমোচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নারী যুক্ত হচ্ছে উন্নয়নের মূলধারায়

391

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২
দারিদ্র্য বিমোচন-নারী
দারিদ্র্য বিমোচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নারী যুক্ত হচ্ছে উন্নয়নের মূলধারায়
ঢাকা, ২০ মে, ২০২০ (বাসস) : সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার বাড়াবিল গ্রামের বাসিন্দা আজাদ মিয়া। ভ্যান চালিয়ে কোনো মতে সংসার চালায়। চার ছেলেমেয়েসহ মোট ছয়জনের সংসারে অভাব প্রতিনিয়ত লেগেই থাকে। একদিন ভ্যান চালালে শরীরের ব্যথায় ২/৩ দিন বসে-শুয়ে থাকতে হয় তাকে। এ নিয়ে স্ত্রী আলেয়ার সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া হয় আজাদ মিয়ার। ঝগড়া কোনো কোনোদিন মারামারি পর্যায়েও রূপ নেয়। সংসারে অভাবের কারণে বাধ্য হয়ে আলেয়া ঝিয়ের কাজ নেয় অন্যের বাড়িতে।
এরই মধ্যে একদিন একজন এনজিও কর্মীর সঙ্গে আলেয়ার পরিচয় হয়। তার কাছে সংসারের সব কথা খুলে বলে আলেয়া। তারপর এনজিও কর্মীর পরামর্শে আলেয়া সংসারে সচ্ছলতা আনার জন্য ঋণ নেয়। আলেয়া প্রথমে স্বল্পসুদে সাত হাজার টকা ঋণ নিয়ে তিনটি ছাগল কিনে তা পালন শুরু করে। এক বছরের মধ্যে ছাগল তিনটি বাচ্চা দেয়। বাচ্চা বিক্রি করে আলেয়া ঋণের টাকা পরিশোধ করে আবারো ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে গাভী কিনে। অল্প কিছুদিন পর গাভীটি বাচ্চা দেয় এবং সেই সঙ্গে উন্নতি হতে থাকে তাদের সংসারে। এরই মধ্যে আলেয়া তার স্বামীকে একটি ভ্যান রিক্সা কিনে দেয়।
আলেয়া এখন সব ঋণ শোধ করে তিনটি গাভী ও তেরটি ছাগলের মালিক। আলেয়ার স্বামী প্রতিদিন সকালে ভ্যানে করে গাভীর দুধ বাঘাবাড়ি মিল্কভিটায় পৌঁছে দিয়ে নিজের কাজে চলে যায়। স্বামীর উপার্জনের পাশাপাশি আলেয়ার উপার্জনের ফলে তাদের সংসারে আর অভাব নেই। আলেয়ার সন্তানেরা এখন স্কুলে যায়। ফলে, তার সংসার এখন সুখ-শান্তিতে ভরা।
দেশে সম্পদের সীমবদ্ধতার কারণে দারিদ্র্য সমস্যা মোকাবিলা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে সরকার পাঁচটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এবং একটি দ্বি-বার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। এসব পরিকল্পনার মূল লক্ষ্যই ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচন। এ যাবৎকাল পর্যন্ত বাস্তবায়িত উন্নয়ন কার্যক্রমের ফলে বাংলাদেশের দারিদ্র্য বেশ হ্রাস পেয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি খাতে উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসনে বাংলাদেশ সাফল্য অর্জন করেছে, যা সকল মহলে সমাদৃত হয়েছে।
আমাদের দেশের নারীদের এক বিশাল অংশ আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত। বিশেষ করে কৃষিপণ্য উৎপাদন, মৎস চাষ, হাঁস-মুরগী পালন, সবজি বাগান, মৃৎশিল্প, বসতবাড়ির আশেপাশে বৃক্ষরোপণ এবং বাঁশ ও বেতভিত্তিক শিল্পপণ্য ইত্যাদি কর্মের সাথে নারীরা সরাসরি জড়িত। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে কর্মরত শ্রমিকের প্রায় ৩৪ শতাংশই নারী। শহর কেন্দ্রিক শ্রম নির্ভর শিল্পে বিশেষত পোশাক শিল্পের ৮০ শতাংশ কাজ তারাই করে থাকে। কাপড় সেলাই, নকশা, বাটিক, বুটিক ও এমব্রয়ডারি ইত্যাদি উপার্জনমূলক কর্মের সাথে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী জড়িত। এছাড়াও, নারীরা যুক্ত আছে বিপনীকেন্দ্র, অভ্যর্থনা ডেক্সে, বিজ্ঞাপণী সংস্থায়, শিক্ষকতা, শিল্পকলা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সরকারের প্রশাসনিক ও নীতিনির্ধারণী মহলের বিভিন্ন স্তরে। কাজেই অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ এখন অনেকটাই প্রশস্ত।
দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসরত ও সামাজিকভাবে প্রান্তিক অবস্থান থেকে ছিটকে পড়া নারীকে উৎপাদনশীল কাজে এবং অর্থনৈতিক মূলধারায় সম্পৃক্ত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নারীরা যাতে অর্থনৈতিক সুযোগ লাভের পূর্ণ অধিকার পায় এবং নারীদের গুণাবলী ও দক্ষতার স্বীকৃতি পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। নারীর অর্থনৈতিক সুযোগ বৃদ্ধি ও সম্পদে সমান প্রবেশাধিকারকে উৎসাহিত করতে হবে। সকল শ্রেণীর, বিশেষ করে দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসরত নারীদের মৌলিক, সামাজিক, শিক্ষাগত এবং চিকিৎসা সেবা পূরণের জন্য সরকারি ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। আর্থিক ও ঋণ সহায়তার সুযোগ যাতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সুবিধাবঞ্চিত নারী উদ্যোক্তারা পায় সে দিকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও রোগ প্রতিরোধ এবং প্রকৃত অর্থে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজনে লিঙ্গ বৈষম্য রোধ, নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নের বিকল্প নেই। কারণ, মৌলিক ও মানবিক চাহিদাগুলো পূরণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের নারীরা এখনো পিছিয়ে আছে। সাংবিধানিকভাবে নারীর অধিকার ও নারী উন্নয়নের কথা বলা হলেও নানা প্রতিকুলতা এবং পুরুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এক্ষেত্রে বড় বাধা। তাই, বাংলাদেশের নারীদের প্রাপ্য অধিকার অর্জনে এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।
দারিদ্র্য মোকাবিলায় নারী শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। কারণ, শিক্ষার সাথে জাতীয় উন্নয়নের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে এটা আজ সুস্পষ্ট যে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তরান্বিত করার ক্ষেত্রে নারী শিক্ষার ভূমিকা অনেক। একজন শিক্ষিত নারী শ্রমিক আর একজন অশিক্ষিত নারী শ্রমিকের মধ্যে পারিশ্রমিকের অনেক পার্থক্য রয়েছে। সুতরাং বেশি অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্রে নারীদের শিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া শিক্ষা সামাজিক কল্যাণ বয়ে আনে। একজন নারীকে লেখাপড়া শেখানোর অর্থই হচ্ছে তার পুরো পরিবারকে শিক্ষিত করা। একজন নারীকে শিক্ষিত করার অর্থ হচ্ছে পরিবার ও সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করা। একজন নারীকে শিক্ষিত করার অর্থ তাকে স্বাবলম্বী করে তোলা। তাই, দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর সম্মিলিত অংশগ্রহণ দরকার।
দেশের ও সমাজের উন্নতির জন্য আলেয়ার মতো ইচ্ছা ও ঐকান্তিক আগ্রহের ধারা যদি সব নারীদের মধ্যে অব্যাহত থাকে তাহলে আর তারা পিছিয়ে থাকবে না। মনে রাখতে হবে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে দারিদ্র্য মোকাবিলা সম্ভব নয়। সরকারের গৃহীত উন্নয়নমূলক কর্মসূচিতে নারীরা যাতে যুক্ত হতে পারে সে সম্পর্কে তাদের সচেতন করতে হবে। নারীদের উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে হবে। সেই সাথে নারী সমাজকে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে পুরুষদের এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই নারী সমাজ উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে পুরুষদের পাশাপাশি দাঁড়াতে সক্ষম হবে।
বাসস/ইউনিফ ফিচার/মুখা/আহো/১৬০০/-আরজি/এসএইচ