সুপার সাইক্লোন আম্পানের প্রভাবে উপকূলীয় জেলাসমূহের সর্বশেষ পরিস্থিতি

291

ঢাকা, ২০ মে, ২০২০ (বাসস) : বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট সুপার সাইক্লোন আম্পানের প্রভাবে উপকূলীয় জেলাসমূহের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে বাসসের সংবাদাতাদের পাঠানো সংবাদে জানা যায়-
ভোলা : ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে জেলার চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলার ১১টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। স্বাভাবিকের চেয়ে জোয়ারের পানি ৪ থেকে ৫ ফুট উচ্চতায় প্রবাহিত হওয়ার কারণে এসব এলাকার কয়েক হাজার মানুষ পানি বন্দী হয়ে আছে। এরমধ্যে চরফ্যশনের চরমানিকা, ঢালচর, মুজিবনগর, চর হাসিনা, কুকরী-মুকরী ও চরপাতিলা এবং মনপুরার মধ্যে চর নিজাম, কলাতলি, কাজির চর, মহাজন কান্দি ও ঢালচরের মনপুরার কিছু অংশ রয়েছে। জেলায় ঘূর্ণিঝড় ঝুঁকিতে থাকা ৩ লাখ ১৬ হাজার ৫০৯ জন মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে আনা হয়েছে।
মনপুরা উপজেলা দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব মো. ইলিয়াস মিয়া বাসস’কে বলেন, সকাল ১০টার পর থেকেই বাতাসের তীব্রতার সঙ্গে পানির বেগ বাড়তে থাকে। আকাশ মেঘলা রয়েছে, সেই সঙ্গে ঝড়ো হাওয়া ও নদী উত্তাল রয়েছে। নদীর পানি ৫ ফুট উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে। পানিবন্ধীদের জন্য খাবার পাঠানোর ব্যবস্থা চলছে। চরফ্যাশন উপজেলা ঘূণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির সহকারী পরিচালক মোকাম্মেল হক বলেন, অতিরিক্ত জোয়ারে এই উপজেলার ভেড়ি বাঁধের বাইরে ৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তবে ভেড়িবাঁধের এ পাশে সবাই নিরাপদে রয়েছে। জেলায় ঘূর্ণিঝড় আম্পান মোকাবেলায় ঝুঁকিতে থাকা ৩ লাখ ১৬ হাজার ৫০৯ জন মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে আনা হয়েছে। মোট ১ হাজার ৪টি সাইক্লোন শেল্টারে অবস্থান করছে তারা। একইসাথে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৫৩৮টি গবাদি পশুকে নিরাপদে রাখা হয়েছে। গতকাল থেকেই বিচ্ছিন্ন ২১টি চরাঞ্চলের বাসিন্দাদের নিরাপদে আনতে কাজ করছে জেলা প্রশাসন। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে সাইক্লোন শেল্টারগুলোতে ছিটানো হয়েছে জীবনু নাশক স্প্রে। এছাড়া ঘূর্ণিঝড় পরবর্তি সময়ের জন্য নেয়া হয়েছে নানান পদক্ষেপ।
জেলা প্রশাসক মো. মাসুদ আলম সিদ্দিক আজ সকাল ১০টায় বাসস’কে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। জেলা প্রশাসক বলেন, দূর্যোগ মোকাবেলায় পুলিশ, কোস্টগার্ড, আনসারসহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে। সাইকেøান শেল্টারে আশ্রয় নেয়া মানুষের জন্য ইফতার, রাতের খাবার ও সেহেরীর খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া ঘূণিঝড় পরবর্তি সময়ের করণীয় সম্পর্কে সরকারি বিভিন্ন বিভাগকে নির্দেশনা দেয়া রয়েছে। আজ দুপুর ২টার মধ্যে ঝুঁকিতে থাকা সকলকে নিরাপদে আনার জন্য কাজ করছেন বলে জানান তিনি। তিনি আরো বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় জেলায় প্রাথমিকভাবে ৭ লাখ টাকা, ২০০ মে. টন চাল ও ৩ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পাশাপিশ এই দূর্যোগে মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে ৭৯ টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। একইসাথে প্রত্যেক উপজেলায় একটি করে টিম গঠন করা হয়েছে, যারা স্ব-স্ব উপজেলার শিশু, বয়স্ক, মহিলা, গর্ভবতী ও অন্যান্য অসহায়দের উদ্ধারে কাজ করবে। এদিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে গত রাত থেকেই জেলা ঝড়ো হাওয়াসহ থেমে-থেমে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। সেইসাথে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন রয়েছে। আজ সকাল থেকে বাতাসের তীব্রতা আরো বৃদ্ধি পায়। সমূদ্র ও নদী তীরবর্তী এলাকাসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে মাইকিং এর মাধ্যমে জনসাধারণকে নিরাপদে থাকার জন্য বলা
বাগেরহাট : সুপার সাইক্লোন আম্পানের প্রভাবে জেলায় আজ ভোর থেকে ধমকা হাওয়া ও বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আম্পান অধিক শক্তিশালী হয়ে ধেয়ে আসার খবরে আজ দুপুর ১২টা পর্যন্ত জেলার আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে ১ লাখ ৬১ হাজার ৮৫০ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ জানান, সবাইকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই আশ্রয়কেন্দ্র রাখা হচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্র গুলোতে হাতধোয়ার ব্যবস্থা রয়েছে এবং সোলার বিদ্যুতের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। রাতে আশ্রয় কেন্দ্রে শুকনো খাবার ও রোজদারদের জন্য সেহেরির ব্যবস্থা করা হয়। ঝুকিপূর্ণ এলাকার বাকিদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসার জন্যপ্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। মাইকিং করে জনসাধারণকে আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে বলা হচ্ছে। শরণখোলা, মোড়েলগঞ্জ, রামপাল ও মোংলা উপজেলার আশ্রয় কেন্দ্রে গতকাল বিকাল থেকে আতংকিত মানুষেরা তাদের গবাদী পশু ও হাঁস মুরগী নিয়ে জেলার ৯৯৭টি আশ্রয় কেন্দ্রে আসতে শুরু করে। পূর্বের ৩৪৫টি স্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রের পাশাপাশি অতিরিক্ত ৬৫২টি আশ্রয় কেন্দ্র বাড়িয়ে ৯৯৭টি করা হয়েছে। ৬ লাখ ধারণ ক্ষমতা বিশিষ্ট এসব আশ্রয় কেন্দ্রে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কমপক্ষে ৩ লাখ মানুষকে নিরাপদে রাখা যাবে। এদিকে সরাকার বাগেরহাট জেলার জন্য ২০০ টন চাল, নগত ৩ লাখ টাকা, ২ লাখ টাকার শিশু খাদ্যে, গো-খাদ্যের জন্য ২ লাখ টাকা ও ২ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ দিয়েছে। দূর্যোগ মোকাবেলায় জেলায় ৮৫টি মেডিকেল টিমসহ ১১ হাজার ৭০৮ জন স্বেচ্ছাসেক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এদিকে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, সুন্দরবনের ঝঁকিপূনণ ৭টি স্টেশন অফিস ও টহল ফাঁড়ির সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পাশ^বর্তি বন অফিসে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এসব অফিস গুলো হচ্ছে কচিকালী, শ্যালা, তাম্বুলবুনিয়া, জোংলা, জাপসী, চরখালী, শুয়ারখালী ফরেস্ট অফিস। একই সাথে সুন্দরবনে অবস্থানরত সকল কর্মচারীদের সর্তক থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ বছর পাশ নিয়ে সুন্দরবনে যাওয়া ২ হাজার জেলে মধ্যে ২০০ জেলে সময়মত ফিরতে না পারায় তাদের বনবিভাগের বিভিন্ন অফিসে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা হয়েছে।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান জানান, ৭ নম্বর বিপদ সংকেত জারির পর থেকেই বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব এলার্ট থ্রি জারি করে বন্দরের জেটি ও বহিনোঙ্গরে অবস্থানরত ১১টি বিদেশী জাহাজের পণ্য খালাস ও বোঝাই কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে। বন্দরের নিজস্ব নৌযানগুলো নিরাপদে রাখার পাশাপাশি পশুর চ্যানেলের সকল জাহাজকে বন্দরের মূল পশুর চ্যানেল থেকে সরিয়ে অন্যত্র নিরাপদে থাকার জন্য বলা হয়েছে। বন্দরে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তি উদ্ধার তৎপরতা চালাতে বন্দর জেটিতে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের জাহাজ অবস্থান নিয়েছে।ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রস্তুত রয়েছে বলেও জানান তিনি।
জেলা প্রশাসক জানান, এবার করোনা পরিস্থিতির মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে যাওয়ায় জেলার আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে সবাইকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই রাখা হচেছ। আজ দুপুর ১২ টা পযন্ত আশ্রয় কেন্দ্রে ১ লাখ ৬১ হাজার ৮৫০ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। ঝুকিপূর্ণ এলাকার বাকিদের আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসার জন্য প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
আশ্রয়-কেন্দ্র
সাতক্ষীরা : জেলার ৭ টি উপজেলায় আশ্রয় কেন্দ্রে আজ সকাল ৯ টা পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষকে আনা সম্ভব হয়েছে। সাতক্ষীরা জেলা এখন ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায়। মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরের প্রায় ৪০০ কিলোমিটারের মধ্যে চলে এসেছে সুপার সাইক্লোন আম্পান। তাই এই দুই বন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত নামিয়ে তার পরিবর্তে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল বাসসকে জানান, এ পর্যন্ত জেলার ৭ টি উপজেলায় ১৪৭ টি সাইক্লোন শেল্টার ও ১ হাজার ৭৯৬ টি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা বিকল্প আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষকে আনা সম্ভব হয়েছে। বাকিদের আশ্রয়কেন্দ্রে আনার জন্য মাইকিংসহ সচেতনতামূলক প্রচারণা চলছে। ঘূর্ণিঝড় এবং দ্বিতীয় পক্ষের চাঁদের সময়ের শেষ দিনের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে থেকে ১০ থেকে ১৫ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে আবহাওয়া অফিসের সূত্র জানায়।শ্যামনগর, আশাশুনি ও কালিগঞ্জ উপজেলায় সকাল ৯ টা পর্যন্ত হালকা বাতাস ও জোর বৃষ্টিপাত হয়েছে। পরবর্তীতে মাঝে-মাঝে বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া বইছে।
লক্ষ্মীপুর : ইতোমধ্যে জেলা সদরের আংশিকসহ রায়পুর, রামগতি ও কমলনগরের উপকূলীয় চরাঞ্চল ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে আনার কাজ শুরু করেছে প্রশাসন। গতকাল মঙ্গলবার বিকেল থেকে জেলার বিভিন্ন স্থানে থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলায় ২৫২টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখার পাশাপাশি পর্যাপ্ত শুকনো খাবার ও ওষুধ মজুদ রয়েছে। তাছাড়া প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীদের অংশগ্রহণে গঠিত ৬৬টি মেডিকেল টিম মাঠে অবস্থান করছেন। এরমধ্যে রেডক্রিসেন্ট কর্মীর সংখ্যা ২২০০ জন ও সিপিপি কর্মীর সংখ্যা ২৪৭৪ জন। জেলা প্রশাসক অঞ্জন চন্দ্র পাল জানান, করোনা পরিস্থিতির কারণে জেলার সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র ১০১টির সঙ্গে অস্থায়ীভাবে আরও ১৫১টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ২ হাজারেরও বেশি গবাদিপশুসহ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার প্রায় ৮ হাজার মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে আনা হয়েছে। ০১৭৩৫০০৩৫৫৫ ও ০১৮১৯৫২৪৮০২ নম্বরে ২৪ ঘণ্টা হটলাইন চালু করে ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতির সার্বিক খোঁজখবর রাখা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। আজ দুপুরে জেলা প্রশাসক অঞ্জন চন্দ্র পাল বাসসকে জানান, লক্ষ্মীপুরে নগদ সাড়ে ১৯ লাখ টাকা ও ৪৯৫ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে শিশু খাদ্যের জন্য ৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা এবং গবাদিপশুর খাদ্যের জন্য ১ লাখ টাকা বরাদ্দ রয়েছে।