তামিমের সিডন্স স্মরণ

385

ঢাকা, ৯ মে ২০২০ (বাসস) : প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসের কারনে যখন পুরো দেশ স্থবির হয়ে পড়েছে এরই মধ্যে ঘরে বন্দি থাকা দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ মানুষদের বিনোদন দিতে ও খেলোয়াড়দের সাথে টিম স্পিরিট বাড়াতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইভ করছে বলে জানান বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম ইকবাল।
গতকাল রাতেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লাইভে আসেন তামিম। এবার তার সাথে ছিলেন দুই পেসার রুবেল হোসেন ও তাসকিন আহমেদ। পরে অল্প সময়ের জন্য অতিথি হিেেসব যোগ দেন ব্যাটিং অলরাউন্ডার নাসির হোসেন। আড্ডা জমাতেই নাসিরকে লাইভে আনেন তামিম। তাতে কিন্তু আড্ডা বেশ জমে উঠে এবং অনেক মজার অজানা ঘটনাও জানতে পারেন ক্রিকেটপ্রেমিরা।
ক্রিকেট মাঠে ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলিকে আউটের পর রুবেলের উল্লাসটা বেশিই থাকে। সেটি বহুবার চোখে পড়েছে সকলের। তাই কোহলিকে আউটের রুবেলের এমন উল্লাসের কারনটা কি, তা জানতে চেয়েছিলেন তামিম। রুবেল বলেন, ‘আমি ও কোহলি একসাথে অনূর্ধ্ব-১৯ খেলেছি। অনূর্ধ্ব-১৯ থেকে তার সাথে দ্বন্দ লেগে আছে আমার। অনূর্ধ্ব-১৯ এ অনেক বেশি স্লেজিং করতো কোহলি। এত বেশি যে, বলার মত না। জাতীয় দলে হয়তো একটু কম স্লেজিং করে। কিন্তু অনূর্ধ্ব-১৯ দলে থাকতে প্রচুর স্লেজিং করতো। এমনকি গালিও দিতো কোহলি। ঐ আসরে তার সাথে খারাপ একটা ঘটনা ঘটেছিল আমার। আমি ওকে আউট করার পর গালি দিয়েছিলাম। আউটে পর গালি দিতে থাকে সে। এরপর আমি তার দিকে তেড়ে যাই। সে নিজেও আমার দিকে তেড়ে আসছিল। আম্পায়ার এসে পরিস্থিতি শান্ত করেন।
আর ঐ ঘটনার পর থেকে তার সাথে আমার দ্বন্দ চলছে। এরপর জাতীয় দলের খেলায় বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের সঙ্গে যেভাবে স্লেজিং করে কোহলি। জাতীয় দলে তার সাথেও আমার কয়েকবার লেগেছে। আসলে এটার শুরু সেই অনূর্ধ্ব-১৯ থেকে।’
এরপর তাসকিনের ব্যাপারে কথা বলেন তামিম। অতীতে একটি স্মৃতি মনে করিয়ে তামিম বলেন, ‘আমরা খুলনায় টি-২০ বিশ্বকাপ প্রস্তুতির ক্যাম্পে ছিলাম।’
তামিমের কথা শুনে ঐ সময় তাসকিন নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তখন তাসকিনকে উদ্দেশ্যে করে তামিম বলেন, ‘এই যে, ভদ্রভাব নিচ্ছিস ক্যান তাসকিন? আমার দিকে দেখ।’
এরপর তাসকিনকে নিয়ে আবারো আলাপ শুরু করেন তামিম, ‘ঐ ক্যাম্পের পর তাসকিনকে একদিন রুমে ডেকে অনেক কথা বলেছি। তাকে বুঝিয়েছি অনেক কিছু। তাসকিনও মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনল।
আমার কথা শুনে তাসকিন বললো, ভাইয়া এভাবে করে তো আমাকে কেউ কখনো বোঝায়নি। এভাবে বোঝালে আমি জীবনে কখনো খারাপ কাজ করতাম না। সব সময় এভাবে চলতাম।
তাসকিন পরে তামিমের রুম ত্যাগ করেন। পরে তামিম কি ভেবেছেন, সেটি তুলে ধরেন বাংলাদেশের ড্যাশিং ওপেনার, ‘তাসকিন যখন এসব কথা শুনে চলে গেল, নিজেকে নিয়ে খুব গর্বিত মনে হয়েছিল। মনে হচ্ছিল, একটা ভালো কাজ করেছি। একটা ছেলেকে বোঝালাম। নিশ্চয়ই আমার কথা কিছু হলেও তার কাজে দিবে। দুই-তিন দিন পর দেখি তাসকিন একই কাজ করে, একই দুষ্টুমি করে।
এরপর দলের আরেক সিনিয়র ক্রিকেটার তাসকিনকে ডেকে আমার মতো একইভাবে বোঝাচ্ছে। তাসকিন দেখি ঠিক আমাকে যেভাবে বলেছে সেভাবেই তাকে বলছে, ভাইয়া এভাবে করে তো আমাকে কেউ কখনো বোঝায়নি। এভাবে বোঝালে আমি জীবনে কখনো খারাপ কাজ করতাম না। সব সময় এভাবে চলতাম।
আমি ওইদিনই বুঝতে পারছি, তাসকিন কত সেয়ানা, কত দুষ্টু।’
এরপর তাসকিনের ক্যারিয়ার প্রসঙ্গ তুলেন তামিম। ক্যারিয়ারের শুরুতে তাসকিনের দুর্দান্ত শুরু থেকে ইনজুরির কারন নিয়ে কথা বলেন তারা। এক পর্যায়ে তাসকিন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম বছরটি আমার খুবই ভালো গেছে। মাঠে নামলেই ভালো করতাম। সবাই আমর সাথে ছবি তুলতো, অনেক মানুষের ভিড় থাকতো। এক বছর হতে না হতেই বিশ্বকাপ খেললাম। বিশ্বকাপের আগে ও পরে মিলিয়ে অনেক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করার সুযোগ পেলাম। অন্যরকম একটা সময়। কখনোই ভাবিনি, খারাপ সময় বা ইনজুরি আসতে পারে। প্রথম দু’বছর অনেক বেশি সিরিয়াস ছিলাম। তৃতীয় বছরে যখন মাথায় ঢুকে গেল ভালো খেলছি, খেলতে নামলেই উইকেট পাই। তখন গা ছাড়া ভাব চলে আসে। এরপর পারফরম্যান্স খারাপ হওয়ার পাশাপাশি ইনজুরিতে পড়লাম এবং দল থেকে বাদ পড়লাম। ইনজুরি থেকে সুস্থ হয়ে দলে সুযোগ পেয়েছি কয়েকবারই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ম্যাচ খেলার সুযোগ পাইনি। ইনজুরি ও অন্যান্য পরিস্থিতির কারণে সুযোগ পাইনি।
আমি এখন বুঝতে পারছি, দুই-তিন বছর দারুন পারফরম্যান্স করার পর যেন নিজের মধ্যে সিরিয়াস ব্যাপারটা থাকে। গা ছাড়া ভাব করা যাবে না। আমি এসব থেকে শিক্ষা পেয়েছি। আশা করি, সিরিয়াস থাকব। এখন আমি অনেক চেষ্টা করছি আবারো দলে সুযোগ পেতে।’
তাসকিন-রুবেলের মাঝে অতিথি হিসেবে নাসিরকে লাইভে নিয়ে আসেন তামিম। তাসকিন-রুবেলের সাথে নাসিরের দারুন বন্ধুত্বপূর্ণ সর্ম্পক। এজন্যই নাসিরকে লাইভে আনা বলে জানান তামিম। নাসিরের কাছে তাসকিন-রুবেলের সাথে মজার ঘটনা জানতে চান তামিম।
নাসিরকে তামিম জিজ্ঞাসা করেন, রুবেলের সাথে প্রথম কবে দেখা হয়েছিলো? নাসির হাসতে হাসতে বলেন, সেটি একটি মজার ঘটনা। নাসির বলেন, ‘মিরপুরে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অনুশীলনে সেন্টার উইকেটে ব্যাট করতে আমি প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। হঠাৎ রুবেল এসে আমাকে বলে, ভাইয়া আমি কি এখানে বসতে পারি। আমি তাকে বলি, হ্যাঁ তুমি বসতে পারো। এরপর তো আস্তে আস্তে আমরা ভালো বন্ধু। একসাথে অনেক খেলেছি। কিন্তু রুবেল এখন আর আমাকে ভাইয়া বলে না। পারলে আমাকে মারে। হা..হা..হা..।’
নাসিরের সাথে তামিমেরও একটি মজার স্মৃতি রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি মজার স্মৃতির কথা নাসির নিজেই তুলেন। তামিম বলেন. ‘ড্রেসিংরুমে প্রায়ই নাসিরকে মজা করে একটা প্রশ্ন করতাম, ধর, বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলছি আমরা। ১ বলে ২ রান দরকার। এই সময়ে একটা ক্যাচ উঠেছে। তুই তো ভালো ফিল্ডার। ক্যাচ উঠছে, ক্যাচটা তুই ফেলে দিয়েছিস। আর আমরা বিশ্বকাপটা হেরে গেছি। তোর তখন অনুভূতি কেমন হবে?’
এমন প্রশ্ন নাসিরকে বহুবার করেছেন তামিম। কাল লাইভে এমন প্রশ্ন তামিমকে করেন নাসির। একটু অন্যভাবে। তামিমকে নাসির জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাই ড্রেসিংরুমে আমরা ক্যাচ নিয়ে মজা করতাম। আমি জানতে চাই, ২০১৫ বিশ্বকাপে অ্যাডিলেডে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে তাসকিনের বলে যে ক্যাচটা ছেড়েছিলেন আপনি, তখন কেমন লেগেছিল আপনার?’
তামিম তখন হাসতে হাসতে বলেন, ‘আগে আমি সব সময় নাসিরের সঙ্গে ক্যাচ নিয়ে মজা করতাম। ক্যাচ মিসের ঘটনাটা যে আমার সাথেই ঘটবে, তা আমি কখনোই বুঝতে পারিনি। ওকসের ক্যাচটা যখন ছেড়েছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল মাটি দুই ফাঁক হয়ে যাক, আমি মুখ লুকাই। আমাকে আর কারও দেখার দরকার নেই। আর ঐ ক্যাচ ছাড়ার পর একসাথে আমি ৩২ কোটি গালি খেয়েছি, এটা নিশ্চিত। কারন বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষ একটা করে গালি দেয়নি, সকলে দু’টো গালি আমাকে দিয়েছেই।’
ঐ ক্যাচ ছাড়ের পর রুবেলই নাকি তামিমকে বাঁচিয়েছেন, ‘ম্যাচ পর সবাই জয়ের জন্য রুবেলের পেছনে দৌঁড়েছে। আর আমি রুবেলের পেছনে দৌঁড়েছি বেঁচে যাওয়ার আনন্দে। যদি ওই ম্যাচ হারতাম আমার আর দেশে আসা হতো না। ঐ ক্যাচ ফেলে দেয়ার পর ড্রেসিংরুমে কান ধরে প্রতিজ্ঞা করেছি ক্যাচ নিয়ে সতীর্থদের সাথে কোন মজা করবো না। তারপরও বিশ্বকাপের ম্যাচে কেন ক্যাচ মিস করি, আমি বুঝতেছি না। ২০১৯ বিশ্বকাপেও রোহিত শর্মার ক্যাচ ফেলেছি। যাই হোক, ২০২৩ বিশ্বকাপ যদি খেলতে পারি ইনশাআল্লাহ সব পুষিয়ে দিবো।’
এরপর নাসির লাইভ আড্ডা ত্যাগ করেন। পরে রুবেল প্রশ্ন করেন তামিমকে, ‘তামিম ভাই আপনার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট কোনটা? থাকে না, এমন ম্যাচ যেখানে আপনি খুব ভালো খেলার পর মনে হয়েছে, এ ম্যাচের পর মানুষ আপনাকে তামিম ইকবাল হিসেবে চিনেছে। মানে আপনি একজন ম্যাচ উইনার, বিগ হিটার। আপনার কাছে এমন ম্যাচ কোনটা?’
তামিম উত্তরে বলেন, ‘ক্যারিয়ারের শুরুতে ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারত ম্যাচের পর থেকে মানুষ আমাকে চিনতে শুরু করে। ওই ম্যাচের পর দীর্ঘ সময় ধরে আমি বলার মতো রান পাইনি, ভালো খেলি নাই। হ্যাঁ, দলে জায়গা পাকা করার জন্য যতোটা প্রয়োজন ততোটা করেছি। তবে বড় কোন পারফরম্যান্স করতে পারছিলাম না। এমন সময় আমাকে বদলে দেয় ঐসময়ের কোচ জেমি সিডন্স। সিডন্স কোচ হবার পরই আমার ক্যারিয়ার পরিবর্তন হয়। আমার মনে হয়, আমার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট যদি বলতে হয় তবে তা হচ্ছে সিডন্স। সিডন্স যখন আসলেন, যখন আমি তার সাথে কাজ করা শুরু করলাম। আমার ব্যাটিং নিয়ে তিনি কাজ শুরু করলেন। আমার শক্তি-দুর্বলতা নিয়ে কাজ করেছি সিডন্সের সাথে। এরপর আমি বড় বড় ইনিংস খেলার আত্মবিশ্বাস পেয়ে যাই। আমার মনে হয়, যতোদিন সিডন্সের অধীনে ছিলাম, সেটাই ছিল আমার টার্নিং পয়েন্ট।’