চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কোটার বিরুদ্ধেই সাম্প্রতিক আন্দোলন : প্রধানমন্ত্রী

1505

ঢাকা, ১৭ জুলাই, ২০১৮ (বাসস): প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সাম্প্রতিক কোটা বিরোধী আন্দোলন প্রচ্ছন্নভাবে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের কোটার বিরুদ্ধেই আন্দোলন।
শেখ হাসিনা আজ মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে সরাসরি (জিটুপি) মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাংক হিসাবে প্রদান কার্যক্রম উদ্বোধনকালে একথা বলেন।
তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের প্রয়োজনীয় সংখ্যায় পাওয়া না গেলে সুপ্রিম কোটের একটি নির্দেশনার আলোকে তাঁর সরকার মেধা তালিকা থেকে শূন্য পদ পূরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আদালতের নির্দেশ অমান্য করতে পারি না এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা বাতিল করতে পারি না। কাজেই আমরা কেবিনেট সচিবের নেতৃত্ব একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছি এই বিষয়টি দেখার জন্য।’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের সাহায্যে কক্সবাজার জেলার সুবিধাভোগী, প্রশাসন এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথোপকথেনের মাধ্যমে ডিজিটাল পদ্ধতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যাকাউন্টে এই সম্মানী ভাতা প্রদান কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব অপরূপ চৌধুরী এই প্রকল্প এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মকান্ডের ওপর একটি প্রেজেন্টেশন অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করেন। মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমান অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।
অপরূপ চৌধুরী জানান, ২ লাখ ৩০ হাজার ৪৩৮ জন গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৪০৪ জন এই ডিজিটাল পদ্ধতি সরাসরি তাঁদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এই ভাতা পাবেন। প্রত্যেকে ১০ হাজার করে টাকা পাবেন। সঙ্গে বাংলা নববর্ষের ভাতাসহ দুই ঈদে দুটি উৎসব ভাতাও থাকবে।

শেখ হাসিনা বলেন, স্বাধীনতার পর জাতির পিতা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা বরাদ্দ করেন। সেই সাথে নারীদের জন্য ১০ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটার ব্যবস্থা করেন।
তিনি বলেন, ’৯৬ সালে সরকার গঠনের পর সরকারি চাকরির জন্য কোন মুক্তিযোদ্ধাকে পাওয়া যেত না। ফলে, সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান এবং নাতি-নাতনীদের অন্তর্ভূক্তির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যাতে রাষ্ট্রপরিচালনায় মুক্তিযোদ্ধাদের অংশগ্রহণ থাকে।’
প্রধানমন্ত্রী এ সময় বেসরকারি টেলিভিশনের ‘টক শো’ কেন্দ্রিক দেশের তথাকথিত বৃদ্ধিজীবীদের সমালোচনা করে বলেন, কিছু বুদ্ধিজীবী যাদের আদালতের রায় সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই তারা ‘টক শো’তে যখন মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিরুদ্ধে কথা বলেন তখন আমার দুঃখ হয়। আন্দোলনের নামে কতিপয় ছাত্র ভিসির বাড়িতে আক্রমণ করে লুটপাট করেছে। এর চেয়ে গর্হিত কাজ শিক্ষার্থীর জন্য আর কি হতে পারে। সেটা নিয়ে তারা কোন উচ্চবাচ্য করেন না – যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোটা বিরোধী আন্দোলনের নামে ভিসির (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) বাড়িতে আক্রমণ, তাঁকে হত্যার প্রচেষ্টা এবং ভাঙচুর ও লুটপাট, একেবারে বেডরুমে ঢুকে লুটপাট চলেছে। অরাজক পরিস্থিতি দেখে আমি বলেছিলাম, ‘ঠিক আছে কোটা থাকবে না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোটা থাকবেনা কিন্তু সাথে সাথে আমাদের এটাও দেখতে হবে স্বাধীনতা বিরোধী যারা যুদ্ধাপরাধী তারা যেন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে না পারে, বা রাষ্ট্রীয় কোন পজিশন না পায় সেটাও দেখতে হবে।
তিনি বলেন, আপনারা জানেন যে, হাইকোর্টে একটা রিট হয়েছিল। সে রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট হুকুম দিল, এই ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকবে, না হলে পদ শূন্য থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটি যখন আপিল বিভাগে যায় তখন আপিল বিভাগ একটা রায় দেয়- ‘কোটা পূরণ করে যদি কোন শূন্য পদ থাকে তাহলে মেধা তালিকা থেকে তা পূরণ করা যাবে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর কাছ থেকে তিনি বিষয়টি অবহিত হয়েই কেবিনেট সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি করে দেন। কারণ, হাইকোর্টের রায় তিনি অবমাননা করতে পারেন না ।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে তাঁর সরকার গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কথাও তুলে ধরেন। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য ভাতা বৃদ্ধি, বিজয় দিবস এবং নববর্ষে ভাতার ব্যবস্থা, মুক্তিযোদ্ধাদের বিনা পয়সায় যাতায়াতের সুযোগ সৃষ্টি, বিনা পয়সায় চিকিৎসা সেবা প্রদান এবং প্রয়োজনে বিদেশে গিয়েও চিকিৎসা গ্রহণের সুবিধা, সারাদেশের জেলা-উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স গড়ে তোলা- প্রভৃতির উল্লেখ করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরব গাঁথা, শহীদদের রক্ত কোনদিন বৃথা যেতে পারে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২১টি বছর এদেশের মানুষ বিকৃত ইতিহাস জেনেছে। এই দেশটাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পকিস্তানের পদলেহনকারীরা কখনই চাইবে না বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে উন্নত হোক।
আওয়ামী লীগ ’৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পরই দেশে উন্নয়নের ধারা সূচিত হলেও মাঝে ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ছিল একটা কালো অধ্যায়, – বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ২০০৮ সালে জনগণ নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়ার পর আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলে তাঁর সরকার এই বর্তমান সময় পর্যন্ত মেয়াদে সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশের হৃত সম্মান ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে কারো কাছে হাত পেতে আমাদের চলতে হয় না। আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির শতকরা ৯০ ভাগ আমাদের নিজস্ব অর্থায়ন থেকে বাস্তবায়নের সক্ষমতা আমরা অর্জন করেছি। আজকের বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল।’
তিনি বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ করেছি, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলেছি। বাংলাদেশের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নতি হচ্ছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। বংলাদেশ ৭ দশমিক ৭৮ ভাগ প্রবৃিদ্ধ অর্জনে সক্ষম হয়েছে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, দারিদ্রের হার কমেছে। জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার যে লক্ষ্য নিয়ে তাঁর সরকার যাত্রা শুরু করেছিল, আজকের ক্ষুধা মুক্ত হয়েছে। সকলে একযোগে কাজ করে একে দারিদ্র মুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলার আহবান জানান প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা জাতির সূর্য সস্তান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে বলেন, যাঁদের মহান আত্মত্যাগে এই স্বাধীনতা, তাঁদের জন্য আমরা যে ভাতার ব্যবস্থা করেছি, আমি জানি কাউকে ভাতা দিয়ে সম্মান দেওয়া যায় না। কিন্তু, আমি চাইনা তাঁরা কেউ কষ্ট পাক। এ কারণেই, এই উদ্যোগটা আমরা নিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভাতার টাকাটা সরাসরি ডিজিটাল পদ্ধতিতে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে যাতে পৌঁছে যায় তার জন্যই এই অনুষ্ঠান। তিনি জানান, পর্যায়ক্রমে সারা বাংলাদেশে যেখানেই মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে, এই ভাতার টাকা সরাসরি তাঁদের অ্যাকাউন্টে পৌঁছে যাবে।