বাসস দেশ-৬ : প্রাণীসম্পদ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতায় রংপুরের গ্রামীন অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার

147

বাসস দেশ-৬ (ছবিসহ)
বিশেষ প্রতিবেদন
প্রাণীসম্পদ-স্বয়ংসম্পূর্ণতা-রংপুর
প্রাণীসম্পদ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতায় রংপুরের গ্রামীন অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার
॥ মো. মামুন ইসলাম ॥
রংপুর, ১৪ জুলাই, ২০১৮ (বাসস) : জেলার সর্বত্রই মাংস, ডিম ও দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হওয়ায় স্থানীয় জনগণের আমিষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি গ্রামীন অর্থনীতিতে ব্যাপক গতিসঞ্চার হয়েছে।
জেলা পশু সম্পদ কর্মকর্তা ডা. মাহবুবুল আলম বাসসকে জানান, ‘বিগত ১০ বছরে জেলায় মাংসের উৎপাদন দ্বিগুণ এবং ডিম ও দুধের উৎপাদন তিনগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় দ্রুত বিকাশমান প্রাণীসম্পদ খাতে বৈপ্লবিক সাফল্যের কারণে গ্রামীন জনপদের সাধারণ মানুষের জীবিকা ও জীবনমানের উন্নয়ন হয়েছে।’
এই সময়ের মধ্যে প্রাণিসম্পদ সেবা বিভাগ (ডিএলএস) জেলার আটটি উপজেলার দু’লাখ ৯০ হাজার খামার মালিক, বেকার পুরুষ ও মহিলা যুবক, ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক কৃষক ও ভূমিহীনকে পশুসম্পদ ও হাঁস-মুরগী পালনসহ ঘাস চাষের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
ডা. মাহবুবুল আলম বলেন, ‘এসব প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বেকার যুবক-যুবতীসহ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক এবং ভূমিহীন মানুষদের মধ্যে এক লাখের বেশি মানুষ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পশুপালন, হাঁস-মুরগী পালন, দুগ্ধ খামার এবং ঘাস চাষের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন করেছেন।’
বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা এপর্যন্ত সমগ্র জেলায় দুই হাজার ৩৪১ টি গরুর খামার, ৪৩০ টি ছাগলের খামার, ৩৪০টি ভেড়ার খামার, ৫২৩টি লেয়ার মুরগী, এক হাজার ৬৫৮টি ব্রয়লার মুরগি এবং ঘাস উৎপাদনের জন্য ২০৪টি খামারসহ মোট পাঁচ হাজার ৪৮৬ টি গবাদি পশুর খামার স্থাপন করে ৪০ হাজারে বেশি সংখ্যক মানুষের চাকুরির সংস্থান করেছেন।
ড. আলম জানান, জেলায় ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে মোট জনসংখ্যার জন্য এক লাখ ১৮ হাজার মেট্রিক টন মাংস চাহিদার বিপরীতে এক লক্ষ ২০ হাজার মেট্রিক টন মাংস উৎপাদিত হয়। পক্ষান্তরে, দশ বছর আগে ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে জেলায় এক লাখ সাত হাজার মেট্রিক টন মাংসের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদিত হয় মাত্র ৫৬ হাজার মেট্রিক টন মাংস।
তিনি জানান, ‘বিগত ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে জেলায় দুই লাখ ৩৭ হাজার মেট্রিক টন দুধের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদিত হয় চাহিদার সমপরিমাণ দুই লাখ ৩৭ হাজার মেট্রিক টন দুধ। অন্যদিকে, এক দশক আগে জেলায় দুই লাখ ১২ হাজার মেট্রিক টন চাহিদার বিপরীতে দুধের উৎপাদন ছিল মাত্র ৭৮ হাজার টন।’
এছাড়াও, বিগত ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে জেলায় ৩২ কোটি পিছ ডিমের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদিত ডিমের সংখ্যা ছিল ৫৫ কোটি ৬৮ লাখ পিছ। অন্যদিকে, এক দশক আগে ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে জেলায় সাড়ে ১৭ কোটি পিছ ডিমের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদিত হয় ২৮ কোটি ১০ লাখ পিছ ডিম।
ড. আলম আরো বলেন, ‘সদ্য সমাপ্ত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে জেলায় দুধের দুই লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন চাহিদার তুলনায় অনেক বেশী দুধ উৎপাদিত হয় এবং মাংস ও ডিমের উৎপাদনও আরো বৃদ্ধি পায়। বিদায়ী ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে উৎপাদিত দুধ, মাংস ও ডিমের পরিমাণ নির্ণয়ে হিসেবের কাজ এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে তিনি জানান।
জেলার কাউনিয়া উপজেলার ছাতাস চওড়াবাড়ী গ্রামের পশুসম্পদ পালনে সফলতা অর্জনকারী দম্পতি হাবিবুর রহমান এবং মনওয়ারা খাতুন জানান, ২০০১ সালে তারা শুধুমাত্র একটি গাভী পালন করার মধ্য দিয়ে এপথে যাত্রা শুরু করেন।
এরপর তারা সরকারি প্রাণিসম্পদ সেবা বিভাগের প্রশিক্ষণ নেয়ার পর মিল্ক ভিটা এবং এবং ব্র্যাক ব্যাংক থেকে ঋণ পেয়ে তা নিয়মিত পরিশোধ করার পাশাপাশি তাদের খামার প্রতি বছর প্রসারিত করতে থাকেন।
বর্তমানে, তাদের ১২ টি গাভী প্রতিদিন ১৫০ কিলোগ্রাম দুধ দেয়। তাদের আরো আটটি গর্ভবতী গরুর বাছুর হলে তাদের খামারে দুধের উৎপাদন আরো বেড়ে যাবে।
এছাড়াও, তারা তাদের খামারে বছরে ১০০ মেট্রিক টন কেঁচো কম্পোষ্ট সার উৎপাদন করেন, সেখানে তাদের ১৬ টি ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল এবং তাদের ২৫টি টার্কি মুরগি রয়েছে। তারা ইতোমধ্যেই ডিম থেকে ৩০০ টি টার্কি মুরগির ছানা উৎপাদন করে বয়সভেদে সেগুলো প্রতিটি দেড়শ’ থেকে তিনশ’ টাকা দরে বিক্রি করেছেন।
রহমান বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের খামারে স্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত আটজন শ্রমিক কর্মরত আছেন এবং তাদের মাসিক মোট বেতন ৩৬ টাকার বেশি। আমাদের খামারে এখন পশু সম্পদের মোট মূল্য ৪০ লাখ কাছাকাছি হতে পারে।’
জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার ময়েনপুর গ্রামের এক সময়ের বেকার যুবক শাহীনুল আলম বকুল বলেন, তিনি ২০০৪ সালে চারটি গরু পালনের মাধ্যমে পশুপালন কার্যক্রম শুরু করেন এবং প্রতিবছর বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও তার খামার প্রসারিত করেন।
এখন, বকুলের খামারে ২৫টি গরু আছে। সাতটি গাভী প্রতিদিন ৬০ কেজি দুধ দেয়। ছয়টি গর্ভবতী গাভী বাছুর জন্ম দিলে তখন দুধের উৎপাদন আরো বাড়বে। সম্প্রতি তিনি নয়টি ষাঁড় ও বাছুর বিক্রি করে তার খামারে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেছেন।
বকুল বলেন, এছাড়াও, সম্প্রতি দশটি ছাগল বিক্রি করার পর বর্তমানে আমার খামারে আরো ৬৫টি ছাগল এবং তিন হাজারটি বেলজিয়ান জাতের হাঁস বিক্রির পর এখনো আরো চার হাজারটি হাঁস রয়েছে।’
বর্তমানে তার খামারে স্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত সাতজন কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন এবং তাদের মোট মাসিক বেতন প্রায় ৬০ হাজার টাকা বলে বকুল উল্লেখ করেন।
বিভাগীয় কমিশনার কাজী হাসান আহমেদ বলেন, বর্তমান সরকারের গৃহীত বিভিন্ন বাস্তবমুখী পদক্ষেপের ফলে পশুসম্পদ খাতে বৈপ্লবিক সফলতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। এর ফলে, স্বাস্থ্যবান একটি জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় মানুষের আমিষ ও পুষ্টি চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিত হচ্ছে।
বাসস/বিশেষ প্রতিবেদন/এমআই/১৬১৫/জেজেড/আরজি