বাসস দেশ-৮ : তিস্তা নদী ভাঙ্গনে বাবার বাড়িতে আশ্রিতা গৃহবধু রেহেনা এখন একজন সফল উদ্যোক্তা

144

বাসস দেশ-৮
গৃহবধু-সফল উদ্যোক্তা
তিস্তা নদী ভাঙ্গনে বাবার বাড়িতে আশ্রিতা গৃহবধু রেহেনা এখন একজন সফল উদ্যোক্তা
॥ মো. জাহাঙ্গীর আলম ॥
লালমনিরহাট, ২০ মার্চ, ২০২০ (বাসস) : মোছা. রেহেনা বেগম (৪৫) একজন সফল উদ্যোগতা। আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক তাকে ঘুরে দাঁড়াতে শিখিয়েছে। পরিশ্রমী এই নারী নিজ বাড়ির উঠানে মুরগির খামার, কোয়েল পাখির খামার, চীনামুরগি, টার্কি ও গাভী প্রতিপালনের খামার গড়ে তুলেছেন। সেই সঙ্গে নিজের বাড়িতে স্থাপিত ইনকিউবেটরে প্রতিমাসে ডিম থেকে গড়ে প্রায় ৪ হাজার বাচ্চা ফুটাচ্ছেন। এসব খামার ও ডিম ফুঁটিয়ে বাচ্চা বিক্রি করে প্রতিমাসে সব খরচ শেষে নিট আয় করছে ৩৫ হাজার হতে ৪০ হাজার টাকা। খামারের দেখা শুনা করছে মা পাশাপাশি বড় ছেলে। প্রতিদিন ২/৩ জন মহিলার খামারে কর্মসংস্থান হয়েছে।
রেহেনা বেগমের ছিল সুখোর সংসার কিন্তু হঠাৎ ১৫ বছর আগে তিস্তা নদীর ভাঙ্গনে সেই সংসারে ছন্দপতন ঘটে। বাড়িঘর ফসলি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। মুহূর্তে রেহেনা ও তার স্বামী পথের ফকির হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে প্রায় ১৫ বছর আগে লালমনিরহাট জেলা সদরের রাজপুর ইউনিয়নের বালাপাড়া গ্রামে তার বাবার বাড়িতে আশ্রিতা হিসেবে ঠাঁই পায়। স্বামী দিনমজুরী করে অতিকষ্টে সংসার চালায়। সংসারে সব সময় অভাব অনটন লেগেই থাকতো। ২৫ বছরের এই সংসার জীবনে কোলজুড়ে আসে তিনটি পুত্র সন্তান। তাদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে, এই চিন্তাই একসময় কুড়েকুড়ে খাচ্ছিল। এ সময় স্বামী মকবুল রাজপুর ইউনিয়নে গ্রাম পুলিশের চাকুরি পায়।
স্বামীর কাছে রেহেনা বেগম শুনতে পান। প্রশিক্ষণ নিয়ে গবাদী পশু ও মুরগির খামার করা যায়। এই খামার করতে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক ঋণ দেয়। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে গবাদী পশু পালনের প্রশিক্ষণ নিয়ে আমার বাড়ি আমার খামার ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক হতে ৮ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ছোট ছোট চারটি বাচ্চা ছাগল বাজার হতে কিনে তিনি প্রতিপালন শুরু করেন। এভাবে দুই বছরে ৪টি ছাগল হতে ১৬টি ছাগল হয়। ছাগল গুলো বিক্রি করে প্রায় ৪৮ হাজার টাকা পায়। পুনরায় আমার বাড়ি আমার খামার ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক হতে ২০১৬ সালের মার্চ মাসে ১৬ হাজার টাকা ঋণ নেয়। ছাগল বিক্রির টাকা, ঋণের টাকায় ও কিছু টাকা আতœীয় স্বজনদের কাছে ধারে নিয়ে এবার সে একটি বিদেশী গাভী কিনে।
গাভী পালনের মাধ্যমে শুরু হয়ে যায় রেহেনা বেগমের নতুন জীবনযুদ্ধ। বাবার বাড়ি ও নিজের ঘর সংসারের কাজ শেষ করে প্রতিদিন বিকেলে গাভীর জন্য কাঁচা ঘাস সংগ্রহ করে এনে গাভীকে খাওয়ায়। একটি গাভী দিয়ে শুরু। পরের বছর আমার বাড়ি আমার খামার ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক হতে নেয়া ১৬ হাজার টাকা ঋণ আয় থেকে পরিশোধ করে। পুনরায় ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেয়। এই ঋণ ও নিজের জমানো অর্থ দিয়ে আরেকটি বিদেশী গাভী কিনে। এভাবে ২০২০ সালের মার্চ মাসে এসে তার খামারে বিদেশী গরুর সংখ্যা হয়েছে ৬টি। এই গাভীর গুলোর মধ্যে একটি বকনা বাছুর রয়েছে। বর্তমানে তার গরুর খামার থেকে প্রতিদিন ৩০/৩৫ লিটার দূধ উৎপাদন হচ্ছে। প্রতিলিটার দুধ ৪০ টাকা দরে বাজারের বিক্রি হয়। এই দূধ বিক্রি হতে প্রতিদিন তার আয় ১৪শত টাকা।
তার বাড়িতে যে মুরগির খামার রয়েছে তাতে প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার ৫শত টাকা মূলের বিভিন্ন ধরণের মুরগি রয়েছে।
রেহেনা বেগমের বাড়িতে এ বছর সরকার বিদূৎ পৌঁচ্ছে দিয়েছে। এই বিদূৎ পৌঁচ্ছে যাওয়ায় তিনি একটি অটোমেটিক ইনকিউবেটর যার ডিম ফুটানোর ধারণ ক্ষমতা প্রায় ২৪ শত ও একটি ম্যানুয়াল ইনকিউবিটর যার ডিম ফুটানোর ধারণ ক্ষমতা ৩শত ক্রয় করেছে। রয়েছে স্যাটার একটি ও হ্যাচার একটি। যার মূল্য প্রায় ৬০ হাজার টাকা। আপদ কালীন বিদূৎ উৎপাদনের জন্য তিনি ৩ হাজার ওয়াটের একটি পুরাতন জেনারেটর ২০ হাজার টাকায় কিনেছেন।
বর্তমানে রেহেনা বেগম বাবার দেয়া কয়েক শতকের বসতভিটার সাথে নিজে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা দিয়ে গ্রামে ১৪ শতক জমি কিনেছেন। সাড়ে ৪ লাখ টাকা দিয়ে ফসলের জমি বন্ধক নিয়েছেন ৪ বিঘা। এই জমির ফসল দিয়ে সারা বছর পরিবারের খাবারের যোগান হয়ে। তাছাড়া খাবারের চাহিদা মিটিয়ে ফসল বিক্রি করে বছরে ৩ বার কিছু অর্থ হাতে আসে। রেহেনা বেগম ৫ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি তিন রুম বিশিষ্ট টিন সেড পাকা ঘর করেছেন। এই ঘরটি বসবাসের জন্য করলেও এখন গাভীর খামার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
বর্তমানে রেহেনা বেগম স্বামী ও তিন পুত্র নিয়ে স্বচ্ছলভাবে জীবন যাপন করেছেন। তার বড় পুত্র মো. আরিফ হাসান (২২) ২০১৭ সালে এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। একটি দুর্ঘটনায় তার পরীক্ষা দেয়া হয়নি। পড়াশুনা এখন বন্ধ। মাকে সাহায্য করতে মার গড়ে উঠা খামারগুলো পরিচালনা করছে। মেজ ছেলে মো. আতিকুর হাসান স্থানীয় রাজপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেনিতে পড়ছে। ছোট ছেলে মো. আরাফাত হাসান বালাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক প্রাথমিকের শিক্ষার্থী। এই নারী এসএমই ঋণ নিয়ে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়েছে। এখন গ্রামে একজন সফল নারী উদ্যোগক্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। তার দেখা দেখি তার গ্রামে ১০/১২ জন নারী তারমত করে খামার শুরু করেছে।
রেহেনা বেগম জেলা সদরের রাজপুর ইউনিয়নের বালাপাড়া আমার বাড়ি আমার খামার গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সদস্য ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সমিতিরও সদস্য। ২০১৪ সালে এই সমিতি যাত্রা শুরু করে ছিল। তার সমিতিতে ৬০ জন করে সদস্য রয়েছে। এদের মধ্যে ৪০ জন নারী। প্রত্যেক সদস্য প্রতি মাসে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে দু’শ টাকা করে জমা করে। সরকার প্রতি তিন মাস পরপর জন প্রতি ৬শত টাকা করে প্রনোদণা দেয়। এভাবে বর্তমানে তাদের সমিতির মূলধন ১১ লাখ ৪৪ হাজার টাকা দাঁড়িয়েছে। এধরণের সমিতি এই রাজপুর ইউনিয়নে ৩০টি রয়েছে। প্রকল্প ও সঞ্চয় ব্যাংক সমিতির মূলধন এক কোটি ২৮ লাখ টাকা দাঁড়িয়েছে।
সদর উপজেলা সমন্বয়কারী ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক লিটন কুমার রায় জানান, সদর উপজেলায় আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের সমিতি রয়েছ ১৬৭টি। যার সদস্য সংখ্যা ৯হাজার ৫শত ৮জন। মূলধন প্রায় ১০ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সমিতি রয়েছে ১১৩টি। সদস্য সংখ্যা ৫ হাজার ৯শত জন। মূলধন দাঁড়িয়েছে ১০ কোটি টাকায়। এই প্রকল্প ও সঞ্চয় ব্যাংক হতে এই উপজেলায় এসএমই ঋণ ১১০ জনের মাঝে ৫৬ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। তবে, কিছু সমস্যা রয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৫ সালের দিকে এই প্রকল্প গুলোতে জনবলের অভাব ছিল। তখন ঋণ বিতরণে সদস্য বাছাই সঠিক ভাবে হয়নি। ফলে, সেই সময়ের দায় নিয়ে চলতে হচ্ছে। তাই, আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পে শতকরা ৫ ভাগ ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে ঋণ আদায়ের হার খেলাপির হার শতকরা ৫২ ভাগ।
লালমনিরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সুবিধাভোগী বাছাই কমিটির সভাপতি উত্তম কুমার রায় জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উদ্যোগগুলো সুন্দর। এতে এনজিওগুলোর ঋণের দৌড়াত্ব কমেছে। গ্রামীণ নারীদেও এক বিশাল অংশের ক্ষমতায় ঘটেছে।
বাসস/সংবাদাদাত/১৪৩১/আরজি