চাঁদপুরে আমার বাড়ি আমার খামার দারিদ্র বিমোচনে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে

1555

চাঁদপুর, ১৭ মার্চ, ২০২০ (বাসস) : ‘শেখ হাসিনার উপহার, ‘আমার বাড়ি আমার খামার’, বদলাবে দিন তোমার আমার’ এ শ্লোগানকে সামনে রেখে দারিদ্র বিমোচনে এ প্রকল্প চাঁদপুরে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছেন। যার ফলে চাঁদপুরের সুফল ভোগীদের আয় বৃদ্ধি পেয়ে দারিদ্র মুক্তি ঘটছে প্রায় ৮০ হাজার দরিদ্র ও হতদরিদ্র পরিবারের। আমার বাড়ি আমার খামার, এ প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার এক দিকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে যেমন সুসংগঠিত করছে। অন্যদিকে সঞ্চয়ের উৎসাহ প্রদান করে সদস্যদের যুবউন্নয়নের মাধ্যমে কর্মমুখী প্রশিক্ষণ দিয়ে আত্মকর্ম সংস্থানের সৃষ্টি করে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করছেন।জেলার প্রতিটি বাড়িকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এবং ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত চাঁদপুর গড়তে বহুমাত্রিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। চাঁদপুরে এ প্রকল্পের আওতায় ২০০৯-২০২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২২২৫ টি গ্রাম উন্নয়ন সমিতি গঠিত হয়ে, যার মাধ্যমে ৮০ হাজার ১১৪ টি পারিবারিক খামার গড়ে তোলা হয়েছে। এর মাধ্যমে চাঁদপুরে গ্রামীণ হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন মানের উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে ও গুরু ত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের ভারপ্রাপ্ত চাঁদপুরের জেলা সমন্বয়কারী জীবন চন্দ্র রায় জানান, ‘সরকার এ প্রকল্পের আওতায় তহবিল সংগ্রহ করে ও খামার গড়ে তোলার মাধ্যমে দারিদ্র নিরসন এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে চাঁদপুর জেলায় দরিদ্র মানুষের স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। এ পর্যন্ত চাঁদপুরে মোট ২ হাজার ২ শত ২৫ টি গ্রাম উন্নয়ন সমিতি গঠন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ৮০ হাজার হতদরিদ্র মানুষ প্রকল্পের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিয়ে তাদের জীবন মান উন্নত করছে।
তিনি আরও বলেন, প্রকল্পের সুবিধাভোগীরা ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত মোট ৩১ কোটি ৩ লাখ ২৩ হাজার ৬৭৭ টাকা সঞ্চয় করেছে এবং সরকার তাদের এ সঞ্চয়ের সঙ্গে ২৩ কোটি ৬৬ লাখ ৪ হাজার ৭৮ টাকা সঞ্চয় বোনাস হিসাবে দিয়েছে। এ সময়ে সরকার সমিতি গুলোকে আবর্তক ঋণ তহবিল হিসেবে ৫৫ কোটি ৩১ লাখ ২১ হাজার ৯৬৩ টাকা দিয়েছেন। সব মিলিয়ে চাঁদপুর জেলায় পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক এর বর্তমান মূলধন বা নিট সম্পদ রয়েছে ১২৩ কোটি ৩৮ লাখ ৪৫ হাজার ৪০৭ টাকা। চাঁদপুরে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের আওতাধীন পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক এর জেলা কার্যালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা সিনিয়র অফিসার জীবন চন্দ্র রায় জানান, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক এর ৮টি শাখা থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে জেলার ৮ টি উপজেলায় মোট ৫৩,৬৪৯ জন দরিদ্র ও অতি দরিদ্র পরিবার ঘুর্নায়মান ঋণ নিয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক থেকে এ পর্যন্ত ১০৫ কোটি ৪২ ৪৩ হাজার টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এর ঋণ আদায়ের হার ৭২%। জীবন চন্দ্র রায় আরো জানান, সরকার গ্রামের প্রান্তিক দরিদ্র ও অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে জামানত-বিহীন আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে এবং তাদের ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে একটি ঘুর্নায়মান ঋণ প্রকল্পের আওতায় এনেছে। বর্তমান সরকার প্রধান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যার বিশেষ উদ্যোগর একটি হলো এ প্রকল্প। এটি ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করে । এরপর ২০১৬ সালে এটি পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে রুপান্তরিত হয়েছে।প্রতিষ্ঠার পর থেকে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক গ্রামীণ দরিদ্রদের জামানত-বিহীন ঋণ সরবরাহের মাধ্যমে সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের বিশেষত নারী উদ্যোক্তাদের আর্থিক সেবা সুবিধার আওতায় নিয়ে আসার ওপর গুরু ত্ব দিচ্ছে। এ গ্রাম উন্নয়ন সমিতির শতকরা ৫০/৬০ ভাগ হলো নারী সদস্য। তারা ঋণ নিয়ে নিজের পরিবার, সমাজ, তথা রাষ্ট্রের উন্নয়নে এখন ভূমিকা রাখতে পারছেন।
চাঁদপুর সদর উপজেলার ৭নং তরপুচন্ডি ইউনিয়নের তরপচন্ডি গ্রামের জসিম হোসেন জানান, ‘আমার বাড়ি, আমার খামার থেকে তিনি উপকৃত হয়েছেন। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে কোন কাগজপত্র, সুদ, ঘুষ দিতে হয়না। সেখান থেকে তিনি সহজ শর্তে দুইদফায় ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে একটি পোল্টি মুরগির খামার করেছেন। মুরগির খামারে এখন ৬০ হাজার টাকার মুরগী রয়েছে । সরকারের এ প্রকল্পটিতে আমি ২০১৬ সালে ভর্তি হয়েছি, আরো আগে জানলে আরো আগেই বেশি উপকৃত হতে পারতাম বলে তিনি জানান। তিনি আরো জানান এক সময় অর্থ কষ্টে ভুগেছেন, পরে আমার বাড়ি আমার খামার এর সদস্য হিসাবে সঞ্চয় জমা করেন সেই সাথে সরকারের দেয়া বোনাস যোগ করে সেই টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সামান্য কিছু মুরগী দিয়ে খামার শুরু করেন, পর্যায়ক্রমে এখন তার খামারে ৬০ হাজার টাকার মুরগী রয়েছে। এখন তার আয় বেড়েছে এ খামার করে। তিনি এখন স্ত্রী সন্তান নিয়ে ভালো আছেন।
চাঁদপুর আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলার ৮টি উপজেলায় এ প্রকল্প এবং পল্ল­ী সঞ্চয় ব্যাংক কার্যক্রম চলছে। এর আওতায় প্রতিটি পরিবার অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে। এ তহবিলের কোনও অর্থই সরকার কখনও ফেরত নেবেনা। জীবন চন্দ্র রায় আরও জানান, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক গ্রামীণ দরিদ্র মানুষদেরকে স্বাবলম্বী হতে বিপুল সুযোগ তৈরি করছেন। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক হাঁস মুরগী পালন, গবাদি পশু পালন, মৎস্য চাষ, নার্সারি, আধুনিক পদ্ধতিতে শাক সবজি আবাদ, দুগ্ধ খামার, গাভী পালন, ছাগল পালন, বেড়ার খামার ও প্রতিপালন, ক্ষুদ্র উদোগতা বা দোকান ব্যবসা, মৃৎশীল্প প্রসারে ঋণ দান, ইলিশ রক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নে জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য ঋণ প্রদান করে থাকে।
চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার বালিথুবা পূর্ব ইউনিয়নের শাইনকিসাইর গ্রামের জাকিয়া বেগম (৩৫) তিনি জানান, তিনি আগে গৃহীনি ছিলেন, শুধু মাত্র নিজের ঘরের কাজ করতেন। এখন তিনি পল্ল­ী সঞ্চয় ব্যাংক থেকে তিন দফায় ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে এখন তিনি সেলাই মেশিন কিনে টেইলারিং দোকান করেছেন, এখন পরিবারের দুঃখ-কষ্ট দূর হয়েছে। পরিবারে এখন তার সম্মান ও বেড়েছে। স্বামী সন্তানের পিছনে উপার্জিত টাকা খরচ করতে পারছেন। পাশের বাজারে স্বামী জন্য একটি কাপড়ের দোকান করার ইচ্ছে আছে বলে জানান তিনি।
একই উপজেলার ১৬ নং রুপশা দক্ষিণ ইউনিয়নের ২ নং চর মান্দারি গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সদস্য নুরুল (৪০) দুই দফায় ২০ হাজার টাকা তুলেছেন পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক থেকে, এখন তিনি সেই টাকা দিয়ে বাস ও বেতের কাজ করেন, তিনি বাস ও বেত দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় তৈজসপত্র তৈরি করে তা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন তা থেকে যে আয় হয় তা দিয়ে প্রথমে কিস্তির টাকা পরিশোধ করে বাকি টাকা দিয়ে সংসার খরচের জন্য ব্যয় করেন। তিনি তার দুই পুত্র ও এক কন্যা নিয়ে খুব ভালো আছেন বলে জানান। তিনি জানান তার সন্তানদের স্কুলের পড়ার জন্য তিনি একজন প্রাইভেট টিউটর ওরেখেছেন। গত কয়েক বছরে আমার বাড়ি আমার খামার এর ঋণ তার জীবন বদলে দিয়েছেন বলে জানান তিনি। এ জন্য বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
সদর উপজেলার কেতুয়া গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সদস্য শাহাজান ঢালি (৫০) জানান, আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের কারণে আমি এখন পরিবার ও সন্তানদেরকে নিয়ে খুব ভালো আছি। আমার স্ত্রী সোমা জাহান (৪৫) ও সমিতির সদস্য হিসাবে ঋণ তুলেছি। প্রথমে ১০ হাজার তারপর ২০ হাজার তারপর ৩০ হাজার এমন করে এখন আমার ঋণ হলো ৫০ হাজার আর আমার স্ত্রীর হলো ৪০ হাজার টাক।, সেই টাকায় আমি উন্নত বীজের সবজি আবাদ শুরু করি, তারপর আর আমাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন আমি ইজাড়া নিয়ে কয়েক একর জমিতে সরিষা , শিম, আলু, বেন্ডি লাগিয়েছি বাম্পার ফলন হয়েছে, তা বিক্রি করে নিয়মিত গ্রাম উন্নয়ন সমিতির টাকা কিস্তি পরিশোধ করেছি।, আর লাভের টাকা দিয়ে সংসার খরচ করে একটি ছোট দোকান করেছি, অবসর সময়ে সেখানে আবার হাত জাল বুনি তা বাজারে বিক্রি করি। তার স্ত্রী সোমা জাহান জানান, তিনি গ্রাম উন্নয়ন সমিতির টাকা তুলে গরু কিনেছেন তা প্রতিবছর কোরবানির সময় বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন, পাশাপাশি তিনি বাড়িতে হাঁস মুরগির ছোট খামার গড়ে তুলেছেন। তিনি বলেন বিনা জামানতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদেরকে যে ঋণের ব্যবস্থা না করলে সন্তানদেরকে না খেয়ে বা পড়াশোনা না করিয়ে রাখতে হতো। আল্লাহর রহমতে আমরা সবাই খুব ভালো আছি। এখন আমাদের অনেক ইচ্ছে ই পূরণ হচ্ছে। তিনি আরো জানান, আমাদের গরু মোটাতাজা করন, হাঁস মুরগির পালন এবং আমার স্বামীর উন্নত সবজি চাষ দেখতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা চেয়ারম্যান পরিদর্শন করেছেন, তারা খুব খুশি হয়েছেন।
কেতুয়া গ্রাম উন্নয়ন সমিতির আরেক সদস্য জাহাঙ্গীর ওজি (৫০) জানান,তিনি ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সবজির আবাদ করেছেন, খুব ভালো ফলন হয়েছিল গতবছর, সেই কারণে পূর্বের ঋণ সময় মত পরিশোধ করেছি, এ বছর আবার ঋণ নিয়ে আলুর আবাদ করেছি ২ একর জমিতে, আরেকটি জমিতে সরিষার আবাদ করেছি, ভালো ফলন হয়েছে, আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের বিভিন্ন উঠান বৈঠক এখন আমার বাড়ির উঠানে হয়ে থাকে। এ অনুষ্ঠানে আমার নিজ এলাকার কৃষকদের উঠান বৈঠকের মাধ্যমে সচেতন করা হয়। আমার উন্নতি দেখে এলাকার অনেক কৃষক গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সদস্য হয়ে ঋণ নিয়ে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে উদ্বুদ্ধ হয়ে খামার করতে আগ্রহী হয়েছে। তিনি পরিবার নিয়ে আগের অবস্থা থেকে এখন উন্নতির দিকে এবং ভালো আছেন বলে জানান।
চাঁদপুরের জেলা প্রশাসকের পক্ষে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প মনিটরিং অফিসার ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিক এস এম জাকারিয়া জানান, প্রধানমন্ত্রীর এ বিশেষ উদ্যো গের ফলে জেলার অতি দরিদ্র মানুষের নতুন করে বাঁচার অবলম্বন হয়েছে। তারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় করে তার সাথে সরকারের সহায়তা যোগ করে জামানত বিহীন ঋণ পাচ্েেছ । এতে করে তারা গত ১০ বছরে জেলায় দারিদ্র্য দূরীকরণে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পেরেছে। আমার বাড়ি আমার খামার ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের মাঠ কর্মীরা সঠিক সময়ে সঠিক প্রকল্প গ্রহণ করেণ , অক্লান্ত পরিশ্রম করেন, তারা সঠিক উপকারভোগী নির্বাচন করেন, এবং এ খাতে আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কারণে অনিয়ন ও দুর্নীতি না থাকায় প্রকল্পটি ভালো করেছে। গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সদস্যদের আয়বর্ধক মূলক কাজের সুযোগ তৈরি করেছে জেলায় আমার বাড়ি, আমার খামার প্রকল্পটি। এটি সফলতার জন্য প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন সময় এ প্রকল্কেপের কর্মকর্তাদের কে সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়ার কারনে সফলতা পেয়েছে। এ প্রকল্পটি এক সময় দেশ থেকে পুরোপুরি দারিদ্র্য দূরীকরণে মূখ্য ভূমিকা রাখতে পারবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।