আদিতমারীতে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের মূলধন প্রায় ১৬ কোটি টাকা

669

॥ মো. জাহাঙ্গীর আলম ॥
লালমনিরহাট, ১২ মার্চ, ২০২০ (বাসস) : জেলার আদিতমারী উপজেলায় আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের মূলধন ১৫ কোটি ৯৮ লাখ ৭৩ হাজার ১৯৬ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এই মূলধন প্রকল্পের ৭ হাজার ৫১৪ জন সদস্য ও ব্যাংকের ৪ হাজার ৫৩৩ জন সদস্যের মাঝে এসএমই খাতে বিনিয়োগ করে সার্ভিস চার্জ আদায় (লাভ) হয়েছে এক কোটি ৭ লাখ ৭৮ হাজার টাকা।
এই প্রকল্প ও ব্যাংকিং কার্যক্রমে জড়িত হয়ে শতশত নারী পুরুষ উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তারা সরকারি উদ্যোগে প্রশিক্ষণ নিয়ে হাঁসমুরগী পালন, গবাদিপশু পালন, মৎস্যচাষ, সবজি চাষ, নাসার্রী স্থাপন ও নানা ধরণের ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনা করে স্বাবলম্বী হয়েছে।
ফলে, হতদরিদ্র পরিবারগুলোর দৈনন্দিন আর্থিক সক্ষমতা বেড়েছে। ফিরে এসেছে সংসারে স্বচ্ছলতা। পরিবার ভিত্তিক ব্যক্তিগত সম্পদের মালিক হয়েছে তারা।
আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের আদিতমারী উপজেলা সমন্বয় অফিস ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক অফিস সূত্রে জানা গেছে, এই উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের অধীনে সমিতির সংখ্যা ১৪২টি ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের অধীনে সমিতির সংখ্যা ৮৪টি। মোট প্রকল্পে সদস্য সংখ্যা ৭ হাজার ৫১৪ জন ও ব্যাংকের মোট সঞ্চয় সমিতির সদস্য সংখ্যা ৪ হাজার ৫৩৩ জন। এই সদস্যদের মধ্যে নারী শতকরা ৬০ ভাগ ও পুরুষ শতকরা ৪০ ভাগ। আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের সদস্যদের দেয়া (প্রতিমাসের দুইশত টাকা) সঞ্চয় জমা হয়েছে ২ কোটি ৪৩ লাখ ১৫ হাজার ৬৬২ টাকা, ব্যাংকের সঞ্চয় জমা হয়েছে ২ কোটি ৪৯ লাখ ৭ হাজার ৮৯৩ টাকা, কল্যাণ তহবিল হিসেবে প্রকল্পখাতে সরকার ভর্তুকি হিসেবে জমা দিয়েছে ২ কোটি ৩২ লাখ ৪০ হাজার ৩৩১ টাকা, সঞ্চয় হিসেবে ব্যাংকে কল্যাণ তহবিল জমা হয়েছে ১ কোটি ৮৯ লাখ ৪ হাজার ৮৬০ টাকা। বর্তমানে প্রকল্পের ঘূর্ণয়মান তহবিল রয়েছে ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ও ঘূর্ণয়মান সঞ্চয় হিসেবে ব্যাংকে রয়েছে ২ কোটি ৩৮ লাখ ৫১ হাজার ৪৫০ টাকা। সার্ভিস চার্জ হিসেবে প্রকল্পখাতে আয় হয়েছে ১৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে সার্ভিস চার্জ হিসেবে আয় হয়েছে ৬৮ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এসএমই খাতে ঋণে জমা রয়েছে ২২ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এযাবত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ঋণ হিসেবে ১৬৩ জন সদস্যের মাঝে ৮৬ লাখ ৬৪ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
প্রতিটি প্রকল্প সমিতি ও সঞ্চয় ব্যাংক সমিতিতে সদস্য সংখ্যা ৬০ জন করে। এরমধ্যে ৪০ জন নারী ও ২০ জন পুরুষ। সমিতির সদস্য নারী ও পুরুষ সকলে ভূমিহীন। সমতলে নারী ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশের কম জমির মালিক, পুরুষের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশের কম জমির মালিক, চর ও পাহাড়ি এলাকার অধিবাসী নারী ও পুরুষদের যাদের জমি এক একরের কম তারা আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সমিতির সদস্য হতে পারবেন। প্রতি সদস্য নারী ও পুরুষ প্রতি মাসে দুই শত টাকা সঞ্চয় হিসেবে জমা দেয়। সরকার প্রতিটি সদস্যের জমার বিপরীতে ৩ মাস পর পর সমপরিমাণ অর্থ র্ভতুকী দেয়। এতে সরকার ৩ মাস পর পর ৬ শত টাকা করে ভর্তুকী দিয়ে থাকে। এভাবেই প্রকল্প ও ব্যাংকে সমিতির সদস্যদের অর্থ সম্পদ হিসেবে জমা হয়। আমার বাড়ি আমার খামার যেমন নিজের তেমনি পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকও সদস্যদের নিজের।
প্রতিটি সমিতির সদস্যদের মধ্যে প্রতিমাসে কমপক্ষে একটি করে উঠান বৈঠক হয়। প্রকল্প ও ব্যাংকে কর্মরত মাঠ কর্মীরা এই বৈঠক আয়োজনে সমিতিকে সহায়তা করে। বৈঠকে সমিতির সদস্যগণ নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয় ক্ষুদ্র উদ্যোগক্তা তৈরীতে কাকে কোন খাতে ঋণ দিবেন। ক্ষুদ্র উদ্যোগক্তাগণ আয় করে ঋণ ৮ শতাংশ সার্ভিস চার্জসহ ঋণ পরিশোধ করতে হয়। ঋণ পরিশোধ করে প্রয়োজনে পুনরায় বেশি অর্থ ঋণ হিসেবে গ্রহন করতে পারে। এভাবে সর্বনিম্ন ৫ হাজার ও সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্য়ন্ত এখনো পর্যন্ত ঋণ সদস্যদের মাঝে বিতরণ করা আছে। ঋণ আদায়ের হার বেশ ভাল।
উপজেলা পর্যায়ে ইউএনওকে আহ্বায়ক ও উপজেলা আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্প ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের উপজেলা সমন্ময়ক ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকগণ সদস্য সচিব করে ১১ সদস্যের কমিটি রয়েছে। এভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দেয়া উপজেলা পর্যায়ের অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাগণ ১১ সদস্যের ইউনিয়ন পর্যায়ে সমিতি পরিচালনা পরিষদের নেতৃত্ব দেয়। উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে উপকারভোগীকে সমিতির বেশির ভাগ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে ১১ সদস্যের সমিতি পরিচালনা পর্যদ নির্বাচিত করে থাকে। একই পদ্ধতি প্রকল্প ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে উপকারভোগী নির্বাচনে প্রযোজ্য হয়। প্রকল্প ও সঞ্চয় ব্যাংকের কার্যক্রম অনলাইনে পরিচালিত হয়ে থাকে। অর্থ লেনদেন সদস্যদের একাউন্টের মাধ্যমে হয়। তাই, সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়েছে।
তবে, প্রকল্প শুরুর দিকে নিজস্ব জনবলের অভাবে ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে প্রকল্পের সমিতি ও ব্যাংকের সমিতি গঠনে ভুলক্রুটি ও অস্বচ্ছতা ছিল বলে অকপটে সকলে স্বীকার করে।
সরজমিনে সরপুকুর ইউনিয়নের টিপার বাজার আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের সমিতির উঠান বৈঠক চলাকালে এই প্রতিবেদক সেখানে হাজির হয়। সেই সমিতির অর্থে দেখা যায় সমিতির কার্যক্রম শুরু হয়ে ছিল ২০১৪ সালের পহেলা জানুয়ারি মাসে। সেখানে ৬০ জনকে নিয়ে সমিতি গঠন হয়। এই সমিতির সঞ্চয় ২ লাখ ৯০ হাজার ৮ শত টাকা। সঞ্চয় অনুদান (সরকারি ভর্তুকি) ২ লাখ ৮৮ হাজার টাকা রয়েছে। ঘুর্ণয়মান তহবিল রয়েছে ৩ লাখ টাকা। সদস্যদের মাঝে উদ্যোগক্তা তৈরি ও স্বাবলম্বী হতে ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ৯ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। এই সমিতির একজন নারী সদস্য ফুলতি রানী হাঁসপালনে ঋণ নিয়েছে ৫ হাজার টাকা ও একই সমিতির একজন পুরুষ সদস্য সুনীল চন্দ্র হাঁসের খামার করতে ঋণ নিয়েছে ২৮ হাজার টাকা। শুরুতে এই সমিতির ঘূর্ণয়মান তহবিল ছিল মাত্র ৭৫ হাজার টাকা। এই তহবিল বেড়েই চলছে।
এই প্রকল্প ২০১১ সালে একটি বাড়ি একটি খামার নামে শুরু হয়েছিল। তখন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যরা এই প্রকল্পে জড়িত ছিল। এখন প্রকল্প চলছে নিজস্ব দক্ষ কর্মী দিয়ে। পরবর্তীতে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের পাশাপাশি প্রকল্পের সদস্যদের সঞ্চয়কৃত অর্থের স্থায়ী সুরক্ষায় ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। বিশেষায়িত এই ব্যাংকটির মালিক সমিতির সদস্যগণ। আইনদ্বারা সমিতির সদস্যদের অর্থের সুরক্ষা দেয়া হয়েছে। সঞ্চয় ব্যাংকের সমিতির সদস্য ছাড়া কেউ এই ব্যাংক হতে ঋণ নিতে পারবে না। প্রকল্পের আওতায় থাকা সমিতির সদস্যদের অধিকার সুনিশ্চিত করতে ২০১৯ সালে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করে আমার বাড়ি আমার খামার করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে নেয়া সামাজিক সুরক্ষামূলক ১০টি প্রকল্পের এটি একটি প্রকল্প।
আমার বাড়ি আমার খামার আদিতমারী উপজেলা সমন্বয়ক ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের আদিতমারী শাখা ব্যবস্থাপক মো. ফরহাদ আলী রানা জানান, তার উপজেলায় ২০১৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে স্থানান্তরিত সমিতির সংখ্যা ৭২টি। পর্যায়ক্রমে সকল সমিতি পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে অধীনে চলে আসবে। সেই লক্ষ্যে কাজ চলছে। এই উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে তার অধীনে দুই জন ফিল্ড অফিসার ও প্রতিটি ইউনিয়নে মাঠ সহকারি কর্মী দুই জন করে মোট ১৬ জন মাঠ সহকারী কর্মী কাজ করছে। তিনি আরো বলেন, মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে কিছু সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। প্রথমত সকল ফিল্ড অফিসার মাঠ সহকারি কর্মীকে নিয়ে অফিসে মিটিংয়ের জন্য হলরুমের অভাব। মাঠ সহকারীদের প্রযুক্তিগত কোন সহায়তা নেই। যেহেতু পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক অনলাইন ভিত্তিক পেপারমুক্ত ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু রয়েছে। তাই, অন্যান্য ব্যাংকের মত এই ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনা করতে নিজস্ব উন্নতমানের সর্ফটওয়্যার থাকলে ভালো হত। ব্যাংকিং কার্যক্রম দ্রুত ও সহজলভ্য হতো। প্রকল্প ও ব্যাংকের সুবিধাভোগীদের উন্নতমানে দ্রততম সময়ে সেবা দেয়া যেত। বিষয়টি উর্ধ¦তন কর্মকর্তাগণ বিবেচনায় নিবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।
আদিতমারী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা এবং আমার বাড়ি আমার খামার ও পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের উপজেলার সমিতিরগুলোর সুবিধাভোগী বাছাই কমিটির সভাপতি মুহাম্মদ মনছুর উদ্দিন (দোলন) জানান, প্রকল্পগুলো সাধারণ মানুষের মাঝে সাড়া ফেলেছে। ব্যক্তি কেন্দ্রীক উদ্যোগক্তা তৈরিতে অবদান রাখছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে প্রকল্প বাস্তাবায়নে এই উপজেলায় মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ও দক্ষ কর্মীদের অভাব রয়েছে। তবে, এই প্রকল্পে কিছু নারী পুরুষ যদি উপকৃত হয়, উদ্যোক্তা তৈরি হয়, তাতেই প্রকল্পের সাফল্য ধরে নিতে হবে।