দিনাজপুরে মাটির বাসনপত্র বিক্রি করে সাবলম্বী হয়েছেন শিক্ষিত যুবক জিপু পাল

780

দিনাজপুর, ৭ মার্চ ২০২০ (বাসস) : জেলার সদর উপজেলায় আমার বাড়ী আমার খামার প্রকল্পের সদস্য হয়ে প্রকল্পের ঋণ সহায়তা নিয়ে মাটির হাড়ি পাতিল বানিয়ে বাজারে বিক্রি করে সাবলম্বী হয়েছে অর্নাস পাশ করা যুবক জিপু পাল ও তার পরিবার।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, দিনাজপুর সদর উপজেলার ৮নং শংকরপুর ইউনিয়নের পালপাড়া গ্রামে প্রায় ২৫টি হিন্দু পরিবারে বসত। তাদের পুর্বপুরুষ মাটির হাড়ি পাতিল বাসনপত্র বানিয়ে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। বাজারে বিভিন্ন ধরনের আধুনিক বাসনপত্র, প্লাস্টিক, সিলভার ও চিনা মাটির বাসনপত্র ব্যাপক হারে সরবরাহ থাকায় এবং মাটির হাড়ি পাতিল বা বাসনপত্র ক্রয়ের আগ্রহ কমে যাওয়ায় এই পেশার লোকজন বেকার হয়ে অন্য পেশায় সরে গিয়েছিল।
গত ২০১১ সালে পালপাড়া গ্রামে ‘আমার বাড়ী আমার খামার’ প্রকল্পের অধীনে পুরুষ ও মহিলাদের সমন্বয়ে ৬০ সদস্যের একটি সমিতি গঠন করা হয়। সমিতির সুপার ভাইজার সত্যেস্বর বসাক জানান, আমার বাড়ী আমার খামার প্রকল্প থেকে ঋণ পেয়ে পালপাড়া গ্রামের সদস্যরা প্রত্যেকেই পূনরায় মাটির হাড়ি পাতিল ও বাসনপত্র বানানো কাজ শুরু করেন। মাটির হাড়ি পাতিল পুনরায় বাজারে আসায় ক্রেতাদের মধ্যেও ক্রয়ের আগ্রহ বেড়েছে। পূর্বের তুলনায় হাড়ি পাতিলের মূল্য অনেকটা ভালো পাওয়া যাওয়ায় পালপাড়ার মাটির হাড়ি পাতিল তৈরীর কারিগরদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা বেড়েছে।
বছর দশেক আগে একটি মাটির হাড়ি বিক্রি হতো ৫ টায়। এখন ওই মাটির হাড়ি বিক্রি হয় ২৫ থেকে ৩০ টাকায়। এভাবে মাটির তৈরী হাড়ি পাতিল বাসনপত্র, দিয়ার, কাঁসা, থালা, বাটি, ঘটি সবকিছুরই চাহিদা যেমন রয়েছে দাম বিগত সময়ের চেয়ে ভালো পাওয়ায় প্রত্যেককের মধ্যে এই কাজ শুরু করার প্রাণ চঞ্চল্যতা ফিরতে শুরু করে। সমিতির সদস্যরা প্রতিমাসে ওই প্রকল্পের সুপার ভাইজার সত্যেস্বর বসাকের মাধ্যমে প্রতি মাসে সঞ্চয় জমা দিতে শুরু করেন। সঞ্চয় দেয়ার ৩ মাস পর আমার বাড়ী আমার খামার প্রকল্পের দিনাজপুর সদর উপজেলা কার্যালয় থেকে প্রত্যেক সদস্যকে ৫ হাজার টাকা করে ঋণ দেয়া হয়। আমার বাড়ী আমার খামার প্রকল্প থেকে তাদের প্রত্যেককে উদ্বুদ্ধ করা হয়, পূর্বের পেশায় মাটির হাড়ি পাতিল ও বাসনপত্র বানিয়ে বাজার জাত করার জন্য।
আমার বাড়ী আমার খামার প্রকল্পের সদর উপজেলা সম্বয়কারী মৌসুমী আক্তার জানান, এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে, হারিয়ে যাওয়া মাটির হাড়ি পাতিল ও বাসনপত্র পূনরায় যাতে মানুষের মধ্যে ক্রয়ের আগ্রহ সৃষ্টি হয় সে জন্য এই পেশাকে আধুনিক বাজারে আসা এলুমিনিয়াম, চিনামাটি ও প্লাস্টিকের তৈরী বাসনপত্রের সাথে এর চাহিদা সৃষ্টি করতে এই সম্প্রদায়কে পেশায় ফিরে নিয়ে যেতে তাদের ঋণ সহায়তা দিয়ে উদ্বুদ্ধ করা হয়। ফলে, পালপাড়া গ্রামের বাসিন্দারা সকলেই মাটি সংগ্রহ করে বাসনপত্র বানিয়ে তাদের ভাটায় বানানো মাটির বাসনপত্র পুড়িয়ে গ্রাহকদের আগ্রহ সৃষ্টি করতে সৌখিন করে বাসনপত্র গুলো বাজারে বিক্রি করছে। বাজারে গ্রাহকদের মধ্যে মাটির তৈরী এসব বাসনপত্র ব্যবহারের জন্য ক্রয় করার চাহিদা বেড়ে গেছে।
পালপাড়া গ্রামের লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, আমার বাড়ী আমার খামার প্রকল্প থেকে গত ২০১১ সালে প্রথম ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে মাটির হাড়ি পাতিল বানানো শুরু করেন পালপাড়া গ্রামের বেকার অর্নাস পাশ করা যুবক সুশীল চন্দ্র পালের পুত্র জিপু পাল (৩০)। তারা ৪ ভাই, ভাইদের মধ্যে জিপু পাল সবার বড়। সে দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে অনার্স পাশ করে বেকার বসে ছিল। অর্থের অভাবে কোন কিছু করতে বা ব্যবসায় ঢুকতে পারেনি। ব্যবসার করতে গেলে অর্থের প্রয়োজন হয়। তাই, সে আমার বাড়ী আমার খামার প্রকল্পের সুপার ভাইজার সত্যেস্বর বসাকের উৎসাহে মাটির হাড়ি পাতিল সৌখিন করে বানিয়ে বাজারে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে এই কাজ শুরু করেন।
নিজের জমি থেকে মাটি সংগ্রহ করে বাড়ীতে বাবা সুশীল চন্দ্র পাল মা, বাসন্তি রানী পাল, ছোট ভাই মিলন পালকে নিয়ে মাটির হাড়ি পাতিল বানানো শুরু করে। প্রথম পর্যায়ে সপ্তাহে যে হাড়ি পাতিল বানানো হয় তা রোদে ২ দিন শুকিয়ে ভাটায় মজুদ করা হয়। প্রয়োজন হয় হাড়ি পাতিল পুড়তে কাঠের খড়ি, ধানের বা কাঠের গুড়া ও খড় দিয়ে ভাটায় আগুন দিতে হয়। প্রায় ৮ থেকে ১০ ঘন্টা ভাটায় আগুনে মাটির বানানো বাসনপত্র গুলো পুরানো শেষ করা যায়। একবার ভাটায় যে পরিমাণ বাসনপত্র পুড়িয়ে তৈরী করা হয় তা বাজার জাত করে প্রথমে ৭ হাজার টাকা বিক্রি করা হয়েছিল। নিজেদের শ্রম বাদে খড়ি, গুড়া ও খর ক্রয় করা হয় দেড় হাজার টাকা। সব মিলিয়ে প্রায় ৫ হাজার টাকা মুনাফা অর্জিত হয়। এভাবে শুরু হয় জিপু পালের হাড়ি পাতিল বানিয়ে বাজার জাত করার ব্যবসা। গত ২০১১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৯ বছর তার এই কাজ চলমান রয়েছে। গত ৩ বছর পূর্বে জিপু বিয়ে করেছেন পার্শ্ববর্তী বিরল উপজেলার পরমেশ্বপুর গ্রামের হরিমহর রায়ের কন্যা আতসী রানীকে। তার স্ত্রী দিনাজপুর সরকারি কলেজে এবার অনার্স শেষ বর্ষে পরীক্ষা দিয়েছে। স্ত্রী পড়াশুনার পাশাপাশি স্বামীকে হাড়ি পাতিল বানাতে সহায়তা করে। তার ছোট ২ ভাই লিটন পাল (১৫) নবম শ্রেনীতে ও সুজন পাল (৮) দ্বিতীয় শ্রেনীতে পড়াশুনা করে। এই পেশায় থেকে ছোট ২ ভাইয়ের পড়াশুনা, বাবা মা, প্রায় শতবছরের বৃদ্ধা তার ঠাকুমা ঠাকুর বালাসহ ৮ সদস্যের সংসার বেশ ভালো ভাবেই এই পেশার উপর দিয়েই জীবন জীবিকা চলছে।
জিপু পাল জানায়, গত জানুয়ারী মাসে তাকে আমার বাড়ী আমার খামার প্রকল্প থেকে ২৫ হাজার টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। মাটির হাড়ি পাতিল ও বাসনপত্র বানানো কাজ আর বন্ধ নেই। প্রতি মাসে ৪ বার করে বানানো হাড়িপাতিল ও বাসনপত্র দিয়ে ভাটা সাজিয়ে আগুনে পুড়ে সৌখিন বাসনপত্র বাজারে বিক্রি করা হয়। বর্তমানে প্রতি মাসে প্রায় ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা বানানো মাটির বাসনপত্র বিক্রি করা হয়। এই আয়ের টাকায় তাদের সংসার চলছে। নিজের জমানো টাকা এবং আমার বাড়ী আমার খামার প্রকল্প থেকে প্রাপ্ত ঋণের টাকা দিয়ে দুটি গাভী, ২টি ছাগল ও বাড়ীতে ১০/১২টি হাঁস প্রতিপালন করছেন। একটি গাভী একটি বাছুর দিয়েছে। গাভীটি প্রতিদিন দেড় থেকে ২ কেজি দুধ দেয়। নিজেরা গাভীর দুধ খায় এবং মাঝে মধ্যেও বিক্রি করে। অপর গাভীটি ৫/৬ মাসের মধ্যেই বাছুর দেয়ার সম্ভবনা রয়েছে।
জিপু পাল জানায়, আমার বাড়ী আমার খামার প্রকল্প শুধু তার নয় পালপাড়া গ্রামের অনেকের ভাগ্যের পরিবর্তন এনে দিতে সহায়তা করেছে। নিজের পরিশ্রম করে পরিবার পরিজন নিয়ে মাটির বাসনপত্র বানিয়ে বিক্রি করে স্বাধীন ব্যবসায় নিয়োজিত থেকে ভালো আছেন। তার গ্রামের একই পেশায় নিয়োজিত বীরেন পাল (৩৫), ললিত পাল (৪০) বিধবা সুচিত্রা রানী (৪৫), মন্টু পাল (৫০), সুধির পাল (৪২), জগেন পাল (৪০)সহ অনেকেই এখন তাদের বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া বাব-দাদার পেশা মাটির বাসনপত্র বানিয়ে বাজার জাত করে সুখে সংসার চালাচ্ছেন। সেই সঙ্গে তাদের পরিবারের ছেলে-মেয়ে কারো পড়াশুনাতে কমতি নেই। পালপাড়া গ্রাম থেকে ১১টি মেয়ে ও ১৩টি ছেলে দিনাজপুর শহরে বিভিন্ন কলেজে পড়াশুনা করে। তাদের ছোট শিশুরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে। প্রত্যেকের বাড়ীতেই এখন মাটির ঘরের পরিবর্তে ইটের ঘর হচ্ছে। দিনাজপুর সদর উপজেলা শতভাগ বিদ্যুতায়ন গত ৩ বছর পূর্বেই হয়েছে। শহর থেকে তাদের গ্রাম পর্যন্ত পাকা রাস্তা ও বাড়ীতে বিদ্যুতের সংযোগে রাতের বেলা বাতি এবং গরমের দিনে ঘরে ফ্যান চলে। তাদের বানানো মাটির বাসনপত্র এখন বাড়ী থেকেই ভ্যান যোগে পাকা রাস্তায় বিভিন্ন হাটে নিয়ে বিক্রি হয়।
স্থানীয় সংসদ সদস্য হুইপ এম ইকবালুর রহিম তাদের বানানো মাটির বাসনপত্র দেখে খুব প্রশংসা করেছেন। তিনি তাদের কোন সমস্যা হলে যোগাযোগ করতে বলেছেন বলে তারা জানান।
আমার বাড়ী আমার খামার প্রকল্পের দিনাজপুর সদর উপজেলা সম্বয়কারী মৌসুমী আক্তার জানান, সদর উপজেলায় ১০টি ইউনিয়নে ৩৩৩টি সমিতি রয়েছে। এর মধ্যে একটি বাড়ী একটি খামার অধীনেই পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন ১৩৮টি সমিতি। অপর ১৯৫টি সমিতি আমার বাড়ী আমার খামার প্রকল্পেই চলমান রয়েছে। সদর উপজেলায় ৩৩৩টি সমিতি গঠন করে ১৯ হাজার ৯৮০ জন পুরুষ-মহিলা সদস্য করা হয়েছে। সদস্যদের সঞ্চয় নিজস্ব তহবিল ৪কোটি ৪৩ লাখ ৮৩ হাজার ৭৭৩ টাকা এবং সরকারি ঋণ তহবিল মিলিয়ে এই প্রকল্পের বর্তমান তহবিল ৯ কোটি ৯৫ লাখ ৬৯ হাজার ৮১০ টাকা রয়েছে।
দিনাজপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএইচ এম মাগফুরুল হাসান আব্বাসী জানান, তিনি গত ২ মাস পুর্বে এই উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ ১০টি উদ্যোগকে সফল করতে উপজেলা প্রশাসন সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম প্রকল্প আমার বাড়ী আমার খামার। তিনি সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়নে গঠিত সমিতিগুলো নিয়ে এই প্রকল্পের কর্মকর্তা কর্মচারীদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করছেন। এই প্রকল্পের ঋণ সহায়তায় বেকারত্ব দূর করতে সহায়তা করবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।