বাসস দেশ-২১ : ১৯৭৫ সালের পরবর্তীতে ৭ই মার্চের ভাষণ সম্পর্কে জাতি অন্ধকারে ছিল : আরেফিন সিদ্দিক

429

বাসস দেশ-২১
মার্চ-৭-আরেফিন
১৯৭৫ সালের পরবর্তীতে ৭ই মার্চের ভাষণ সম্পর্কে জাতি অন্ধকারে ছিল : আরেফিন সিদ্দিক
॥ মলয় কুমার দত্ত ॥
ঢাকা, ৬ মার্চ, ২০২০ (বাসস) : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার পরে দীর্ঘ ২১ বছর বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি সম্পর্কে জাতি অন্ধকারে ছিল।
বঙ্গবন্ধু-পরবর্তী যুগে এই মহান নেতার ভাষণ কিংবা যারা পাকিস্তান দখলদারদের পরাধীনতা থেকে জাতির স্বাধীনতার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলন তাঁদের সম্পর্কে যুবসমাজের কোন ধারণা ছিল না।
‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে, ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত যে সকল যুবক টেলিভিশন দেখতে কিংবা রেডিও শুনতে সক্ষম হয়েছিল তাদের কাছ থেকে ভাষণটি আড়াল করে রাখা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে সরকার গঠন করার পরে মানুষ ঐতিহাসিক ভাষণটি শুনতে শুরু করেছিল।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক আজ এক সাক্ষাৎকারে বাসসকে একথা বলেন।
তিনি বলেন, তাঁর যুগান্তকারী ভাষণের অডিও-ভিজ্যুয়াল রেকর্ডটি ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত কোনও ধরণের মাধ্যমে প্রচার কিংবা সম্প্রচারিত হয়নি।
অধ্যাপক আরেফিন বলেন, এই সময়ে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বা জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ভাষণটির অডিও রেকর্ডটি কেবলমাত্র আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা বাজিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা বঙ্গভবনে শপথ নেয়ার ঠিক পরে সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রথম বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করেছিল।
ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আরেফিন বলেন, টেলিভিশনে রেকর্ড করা বক্তব্য দেখার পরে, বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীরা তাকে বলেছিল এবং তিনি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও জানতে পেরেছিলেন, যুবকরা কখনও ভাবতে পারেননি যে তাদের এমন একজন মহান নেতা ছিলেন।
তিনি বলেন,‘তারা ভাষণের অডিও রেকর্ড শুনে থাকতে পারে। তবে যখন তরুণ প্রজন্মের কাছে প্রথমবারের মতো তুলে ধরা হয়েছিল ভাষণের অডিও-ভিজ্যুয়াল উপস্থাপনায়, তখন তারা দেখেছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং তাঁর নেতৃত্বের মহিমা, তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং সাহসিকতার চিত্র।’
অধ্যাপক আরেফিন জানান, প্রথমবারের মতো ভিডিও রেকর্ড দেখে যুবকরা তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বজ্রকেেন্ঠর ভাষণ, বঙ্গবন্ধুর দেহের ভাষা, অঙ্গভঙ্গি, অঙ্গবিন্যাস, শব্দচয়ন এবং কথা বলার স্টাইল পর্যবেক্ষণ করেছে।
‘ওইদিনের আগে তারা ভাষণ দেখার কোনও সুযোগ পায়নি। হঠাৎ ভাষণটি দেখার পরে তাদের মধ্যে একটি প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল।’
অধ্যাপক আরেফিন বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণকে আড়াল করে রাখার উদ্দেশ্য ছিল, পাকিস্তানের দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে স্বাধীনতা-প্রেমী বাঙালিদের উজ্জীবিত করা সেই ভাষণের শক্তিকে লুকিয়ে রাখা।
তিনি বলেন, ‘নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন, তবে তাঁর ভাষণ ছিল আমাদের সঙ্গে। মনে হয়েছিল বঙ্গবন্ধু আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। যুদ্ধের ময়দানে মুক্তিযোদ্ধারা ওই ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন।’ তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় জনগণ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে ভাষণ শুনেছিলেন।
ঢাবি’র সাবেক উপাচার্য বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণের বিশাল শক্তি উপলব্ধি করে তাঁর হত্যাকারী ও দুষ্কৃতিকারীরা ভয়ে পেয়ে আতঙ্কিত হয়েছিল।
তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘সুতরাং, আমি বিশ্বাস করি, নতুন প্রজন্মের সামনে বারবার ভাষণটি উপস্থাপন করা আবশ্যক। এই ভাষণটি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হওয়াও উচিত এবং এটি শ্রেণি কক্ষে শেখানো উচিত।’
প্রফেসর আরেফিন বলেন, ‘যদি এটি করা যায় তবে বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও ব্যক্তিত্ব যুবসমাজের কাছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ছড়িয়ে দেয়া যেত।’
সাবেক ভিসি বলেন, বক্তব্যটি নিজেই একটি দুর্দান্ত পাঠ্যপুস্তক এবং যুবকদের এই পাঠ্যপুস্তবকটি শেখানোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
তিনি বলেন, ইউনেস্কো এই বিষয়টি উপলব্ধি করেছে এবং সে কারণেই সংস্থাট এই ভাষণ মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করেছে, এটি জাতিসংঘের সংস্থা দ্বারা পরিচালিত বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টারি হেরিটেজের একটি তালিকা।
তিনি বলেন, “মানব সভ্যতা হাজার বছর কেটে যাওয়ার পরে বর্তমান রূপে এসেছে। সভ্যতাকে তার এই আধুনিক রূপে আনতে অনেক মানুষের অবদান রয়েছে”।
তিনি আরও বলেন, বঞ্চিত, নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতার বিশাল ভূমিকা রয়েছে।
অধ্যাপক আরেফিন বলেন, এই বক্তৃতার শেষ কথাটি ছিল ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তিনি বলেন, মুক্তির এই সংগ্রাম হলো মানব সভ্যতার জন্য সকল প্রকার দমন থেকে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতার সংগ্রাম।
অধ্যাপক আরেফিন বলেন, ১৯৭১ সালে এই ভাষণের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা যেমন ছিল ২০২০ সালেও তেমনি রয়েছে এবং ২০৫০ সালের ৭ই মার্চে যখন বাঙালিরা দিবসটি পালন করবেন একইভাবে এর গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা থাকবে।
তিনি বলেন, “ভাষণটি বঙ্গবন্ধুর দর্শনের অংশ ছিল। স্বাধীনতার পর সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কর্মসূচিতে তাঁর ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলতেন যে ‘গোটা বিশ্ব এখন দুটি ভাগে বিভক্ত। একটি অংশ নির্যাতিতের এবং অন্যটি নির্যাতনকারীদের। আমি নিপীড়িত মানুষের পক্ষে।”
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু তার শহীদ হওয়া অবধি নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করেছিলেন।
সাবেক ভিসি বলেন, ‘আমরা যদি বক্তৃতার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করি তবে আমরা দেখতে পাই বহির্মুখী এই ভাষণটি তার হৃদয় থেকে খুব সহজে বেরিয়ে এসেছে।’
তিনি আরো বলেন, “সুতরাং, এটিকে বক্তৃতা নয়, কথোপকথন বলা যেতে পারে। তিনি যখন কথোপকথনের মাধ্যমে জাতির সামনে ভাষণটি তৈরি করেছিলেন যেন তিনি জনগণের সাথে কথা বলছিলেন।”
বাসস/অনু-কেজিএ-জেহক/২১৪৫/কেকে