তিস্তার বালুচরে সবুজের সমারোহ

629

॥ মাজহারুল আলম মিলন ॥
রংপুর, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ (বাসস): জেলার কাউনিয়া উপজেলার তিস্তা নদীর ধুধু বালুচরে সবুজের সমারোহ দেখে যে কেউ অবাক হয়ে যাবেন। সরেজমিনে পরিদর্শন করে জানা গেছে, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরই যে অস্থায়ী চর জেগে উঠেছিল সেখানে বিভিন্ন ধরনের ফসলের চাষ আলু, মিষ্টি কুমড়া, মরিচ, পেঁয়াজ, স্কোয়াস, গম ইত্যাদি শোভা পাচ্ছে। ধুধু বাুলচর যেখানে আসলে কোন কিছুই হওয়া সম্ভব নয় সেখানেও দেখা যাচ্ছে মোটা বালির উপর মিষ্টি কুমড়া গাছের সবুজের বিস্তার দিয়ে পুরো চর ঢেকে গেছে। পুরো চরেই যাতে নিরাপদ মিষ্টি কুমড়া উৎপাদন করা যায় সে জন্য শোভা গাছে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ ও ইয়োলো স্টিক ট্রাপ। ওই উপজেলার ২টি ইউনিয়নের ৩টি চরেই ১০০ একর ধুধু বালুচরে সবুজের সমারোহ।
উপজেলার টেপা মধুপুর ইউনিয়নের হরিচরণ শর্মা চরের কৃষক শফিকুল ইসলাম, মামুন, বালাপাড়া ই্উনিয়নের ডুসমারা চরের মোতালেব, ইব্রাহীম, গনাই চরের মনসুর, আসাদুজ্জামান বাসসকে জানান, কৃষি বিভাগের তত্ত্বাবধানে প্রায় ১০০ শতক করে বালু চরে মিষ্টি কুমড়ার আবাদ করেছেন। তাদের মিষ্টি কুমড়া গাছের অবস্থা খুবই ভালো। এখনও কোন রোগ বা পোঁকার আক্রমণ হয়নি। ইতিপূুর্বে জাব পোঁকার কারণে পাতা হলুদ হয়ে যেত, মাছি পোঁকার কারণে কুমড়া নষ্ট হয়ে যেত। হলুদ ফাঁদ দেওয়ায সমস্ত জাব পোঁকা সেখানে আটকে যাচেছ এবং মাছি পোঁকা ফেরোমন ফাঁদে পড়ে মারা যাচ্ছে, ফলে জমিতে এখনও কোন প্রকার কীটনাশক ছিটাতে হয়নি। ধুধু বালুচরে এ সবুজের সমারোহ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে উত্তরে সকল কৃতিত্ব উপজেলা কৃষি বিভাগের জানান কৃষকরা। বিশেষ করে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সাইফুল আলম ও উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা এমদাদুল হকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। কৃষকরা বাসসকে আরও জানান, উপজেলা কৃষি অফিসার নিজ উদ্যোগে কৃষকদের কাছে এসে বালুচরে মিষ্টি কুমড়া চাষের প্রস্তাব দেয়। চরে মিষ্টি কুমড়া উৎপাদনে সকল চাষীকে প্রশিক্ষণ শেষে উদ্বুদ্ভকরণ করেন। মিষ্টি কুমড়া চাষে প্রয়োজনীয় সার, পলিথিন, ফেরোমন ফাঁদ, ইয়োলো স্টিক ফাঁদ, সেচের জন্য নগদ অর্থ ও সেচপানি ধরে রাখার জন্য পলিথিনসহ নানাভাবে সহযোগিতা করেন। নিজেরাও বিশ^াস করতে পারিনি ধুধু বালুচরে মিষ্টি কুমড়া চাষ হবে, কিন্তু এখন গাছের চেহারা ও বৃদ্বি দেখে আমরা সকল কৃষক আনন্দে রয়েছি।
কাউনিয়া উপজেলার তিস্তা চরের চিত্র বদলে সবুজের সমারোহের মূল কারিগর হচ্ছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সাইফুল আলম। তিনি বাসসকে জানান, চর এলাকার শ্রমজীবী কৃষক ভাই ও সংশ্লিষ্ট ব্লকের উপ সহকারি কৃষি কর্মকর্তা এমদাদুল হকের কঠিন শ্রম ও প্রচেষ্টার ফসল এ সবুজের সমারোহ। আমি শুধু তাদের সবাইকে সহযোগিতা করেছি। ফেরোমন ফাঁদ, ইয়োলো স্টিক ফাঁদ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, এ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে চরের চাষীরা কোন প্রকার কীটনাশকের ব্যবহার ছাড়াই কুমড়া উৎপাদন করবে। ফলে উৎপাদিত কুমড়া হবে নিরাপদ, কৃষকের উৎপাদন খরচ কমবে, বাজার মূুল্য বেশি পাবে। এছাড়াও কৃষিবান্ধব সরকারের উদ্যোগ জনগণের কাছে নিরাপদ খাদ্য পৌঁছে দেওয়া। ফসলের জমিতে রাসায়নিক বালাইনাশকের ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে নিরাপদ জৈব বালাইনাশক ও জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর ফলে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন সম্ভব হবে। এ লক্ষ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব ও মহাপরিচালরেক প্রত্যক্ষ দিক নির্দেশনায় নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে কৃষি বিভাগ।
কিভাবে এত বড় উদ্যোগ নিলেন এমন প্রশ্নে জানান, ২০১৮ সালে কাউনিয়ায় যোগদানের পর দেখি কাউনিয়া উপজেলায় ৩০টি চরে জমির পরিমান ২৪০০ হেক্টর। এর মধ্যে স্থায়ী চরে জমির পরিমান ১৯৫০ হেক্টর। সেখানে সব ধরনের ফসল উৎপাদন হয় কিন্তু অস্থায়ী বালুর চরের পরিমাণ প্রায় ৪৬০ হেক্টর সেখানে কোন ফসল হয় না। এ অস্থায়ী ধুধু বালু চরে কিভাবে ফসল উৎপাদন করা যায় সেই লক্ষ্য অর্জনে কাজ শুরু করি। যার ফলশ্রুতিতে বর্তমানে প্রায় ১০৩ হেক্টর অস্থায়ী বালুর চরের জমি আবাদের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন চরে সব কিছুই খুবই শ্রম ও ব্যয়সাধ্য তবে চরের মানুষ খুবই পরিশ্রমী । বাইরে থেকে সকল প্রকার কৃষি উপকরণ বিশেষ করে মাটি জৈবসার, রাসায়নিক সার, পানি পরিবহন করে চরে আবাদ করতে হয়।
এ ধরনের উদ্যোগের কথা উপজেলা পরিষদে জানালে পরিষদ অর্থের সংস্থান করেন। এ অর্থের মাধ্যমে চরের ১০০ জন চাষী ঠিক করা হয় যার মাধ্যমে ১০০ একর মিষ্টি কুমড়ার চাষ করা হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ পিপিপি এর ভিত্তিতে সরবরাহ করা হয়। এ দ্বারা মিষ্টি কুমড়া উৎপাদনে যাতে কোন ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করা না হয় সে জন্য প্রশিক্ষণ, জৈবসার, সেক্স ফেরোমন ফাঁদ, ইয়োলো স্টিক ফাঁদ কৃষকদের মাঝে সরবরাহ করা হয়। তিনি বলেন এ ১০০ একরে যে মিষ্টি কুমড়া উৎপাদিত হবে তা সম্পূর্ণ র্বিষমুক্ত, এর বাজার মূল্য বেশি হবে। এছাড়া এ কুমড়া যাতে বিদেশে রপ্তানী করা যায় সে জন্য কৃষি বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে।
রংপুর জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. সরয়ারুল হক বাসসকে জানান, কাউনিয়া উপজেলা পরিষদের আর্থিক সহায়তায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নিবিড় তত্বাবধাণে মিষ্টি কুমড়া উৎপাদন কার্যক্রম পরিদর্শনে জেলা প্রশাসক ও অন্যাণ্য সফরসঙ্গী দের নিয়ে নৌকায় যাত্রা করি। তিস্তা নদীতে জেগে উঠা ধু ধু বালুচরে সারাদিন। মিষ্টি কুমড়া উৎপাদনে চরের কৃষকদের আর্থ সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখার পাশাপাশি নিরাপদ সবজির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন কৃষিবিদ সাইফুল আলম। নিরাপদ সবজি উৎপাদনে ও বালু চরকে ফসলের জমি হিসেবে অর্ন্তভুক্ত করণে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে পরিগণিত হবে। উল্লেখ্য, সম্প্রতি জেলা প্রশাসক আসিব আহসান, কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব দেলয়ার হোসেন সরেজমিন এচর পরিদর্শন করেন।