বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২
শিশু-পুষ্টি
অপুষ্টি প্রতিরোধে বসতবাড়িতে মাছ ও সবজি চাষ
ঢাকা, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ (বাসস) : মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার মরিয়ম বেগম (৪৬) পাঁচ বছরের নাতনিকে স্থানীয় ইপিআই কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন। শিশুটিকে দেখে তিন বছর বয়সী বলে মনে হয়। শরীরে অপুষ্টির চিহ্ন ছাপ সুস্পষ্ট। মরিয়ম বলেন, “শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাবার এত গুরুত্বপূর্ণ তা আগে জানতাম না। এখন কয়েক মাস পর পর আমার নাতনিকে ইপিআই কেন্দ্রে নিয়ে এসে তার ওজন মিলিয়ে যে খাবারের মেনু দেয়া হয়, সেইভাবে খাওয়াই। এতে আগের চেয়ে তার অবস্থা ভালো হচ্ছে।”
বাংলাদেশে মরিয়মের নাতনির মতো অনেক শিশুই অপুষ্টির শিকার। তবে সিলেট বিভাগে এ হার অনেক বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিশুর অপুষ্টি একটি বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা, যা দীর্ঘ সময় ধরে নি¤œমানের খাবারের কারণে হয়ে থাকে। সাধারণত নারী ও শিশু অপুষ্টিতে ভোগে বেশি। শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব লÿ্য করা যায়। এটি তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, মেধার উন্নয়ন, রোগব্যাধি ও শিÿাগত অর্জনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এ কারণে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে শিশুদের পুষ্টির অবস্থা ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাকে দেশের সবচেয়ে দুর্বল সংবেদনশীল সূচক হিসেবে গণ্য করা হয়।
‘বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক এন্ড হেলথ সার্ভে ২০১৪’-এর রিপোর্ট থেকে জানা যায়,“সিলেট বিভাগে সারা দেশের মধ্যে অপুষ্টির হার সবচেয়ে বেশি। এখানে পাঁচ বছরের কম বয়সী শতকরা ৪৯.৫ ভাগ শিশু খর্বকায়; যা তীব্র অপুষ্টির পরিচয় বহন করে। এখানে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার প্রতি ১০০০ জনে ৬৭। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে মা ও শিশুর অপুষ্টি এবং খর্বতার হার তুলনামূলক বেশি হওয়ায় তারা দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টিচক্রে আক্রান্ত।”
এসব কারণে এ বিভাগে মা ও শিশুর পুষ্টি চাহিদা পূরণে ‘ওয়ার্ল্ড ফিস’ নামে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। তারা আটটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে একটি কনসোর্টিয়াম গঠন করে বিভিন্ন ধাপে দরিদ্র ও অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে পাঁচ বছর ধরে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করছে। ‘ওয়ার্ল্ড ফিস’-এর জেলা মৎস্য বিশেষজ্ঞ ড. মো. মাহবুবুল আলম মিঞা বলেন, “সূচনা প্রোগ্রাম নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা বসতবাড়িতে মাছ ও শাক-সবজি উৎপাদনের মাধ্যমে সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কাজ করছি। মা ও শিশুর পুষ্টির উন্নয়নের মাধ্যমে দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের খর্বাকৃতির হার অতিরিক্ত ৬ শতাংশে কমিয়ে আনার লÿ্যে আমরা সরকারের সহযোগিতা নিয়ে আটটি প্রতিষ্ঠান বিভিন্নভাবে কাজ করছি।” তিনি আরো বলেন, “অর্থিক অসচ্ছলতা, ভূমিহীন,আধা শ্রমিক, স্বল্প আয়ের মানুষ, যারা দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে পুষ্টিকর খাবার কিনে খেতে পারে না এবং যাদের পুষ্টি বিষয়ে জ্ঞান নেই, তাদেরকে মাছ ও সবজি চাষ ছাড়াও পুষ্টিজ্ঞান ও সুস্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করে তোলার লÿ্যে আমরা কাজ করছি।”
জন্মের প্রথম ১০০০ দিন শিশুর সুস্থতা, বিকাশ, বৃদ্ধির অগ্রগতি এবং উন্নতির জন্য পুষ্টিগত অবস্থা একটি পরিমাপক হিসেবে বিশ^ব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক হিসেবে বিবেচিত। এটাকে গুরুত্ব দিয়ে সূচনা প্রকল্প কাজ করছে বলে জানান কনসোর্টিয়ামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান ‘সেভ দ্যা চিলড্রেন’-এর সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার ডা. রাইসুল হক। তিনি বলেন, “জন্মের পর প্রথম ১০০০ দিনকে গুরুত্ব দিতে হলে কয়েক ধাপে শিশুর যতœ, টিকাদান এবং খাবারের বিষয়গুলোর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হয়। এজন্য শিশুর জন্মের দিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত শুধুমাত্র বুকের দুধ, ৬-৯ মাস বয়সী শিশুর জন্য ২৫০এমএল খাবারের অর্ধেক বাটি দিনে দুই বার, ৯-১১ মাস বয়সীদের দিনে তিন বার এবং ১২-২৩ মাস বয়সীদের পুরো বাটি দিনে ৩-৪ বার দিতে হবে। এ খাবারের মাঝখানে শিশু পুষ্টিকর ¯œ্যাকস খেতে
পারে।” তিনি আরো বলেন, “শুরুতে ওই জনগোষ্ঠীর অবস্থা অনেক খারাপ ছিলো। এখন ক্রমেই অনেক ভালোর দিকে এগুচ্ছে। আমরা সরকারের ইপিআই কেন্দ্র ব্যবহার করে কাজ করছি। প্রয়োজনে মা বা শিশুকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও পাঠাচ্ছি।”
মৌলভীবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. এমদাদুল হক বলেন, “মাছ ও সবজি চাষ মূলত নারীরাই করছেন। আমরা সরকারের পÿ থেকে তাদেরকে কারিগরি দিকে অর্থাৎ মাছ চাষের প্রশিÿণ, পরামর্শ প্রদান এবং কাজ পর্যবেÿণ করে থাকি। এটা শুধু পুষ্টি ঘাটতি পূরণেই কার্যকরী ভূমিকা রাখছে না, বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও সহায়তা করছে। কিছুদিন আগে ভারতের উড়িষ্যার একদল পর্যবেÿক এসেছিল এ প্রকল্প দেখতে। তারা এ ধরনের কার্যক্রম তাদের এলাকায় চালু করার কথা ভাবছেন বলে জানান। ভারতের জাতীয় পর্যায়েও এমন ভালো কাজ সম্প্রসারণের বিষয়েও নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে চিন্তাভাবনা চলছে বলে জানা যায়।”
প্রকল্প তাদেরকে বছরে দুই বার শীত ও গ্রীষ্মে বীজ ও মাছের পোনা বিতরণ করে। তেলাপিয়া, মলা এবং কার্প জাতীয় মাছের পোনা এবং ৭-৮ ধরনের বীজ (লালশাক, কলমি শাক, মিষ্টিকুমড়া, সীম, রাইশাক, ডাঁটাশাক, কচুরলতি, বরবটি) বিতরণ করা হয়। যাদের জায়গা কম, তারা বর্গা নিয়ে এসব চাষ করছে। নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে তারা উদ্বৃত্ত সবজি ও মাছ বিক্রি করে দু’টি পয়সার মুখ দেখছে।
দেশের অন্যান্য এলাকায় এরকম কাজ মানুষের অপুষ্টি প্রতিরোধ এবং জীবনমান পরিবর্তনে যেমন সহায়তা করবে, তেমনি জাতীয় উন্নতিতেও উলেøখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। এছাড়াও এই কাজের মাধ্যমে নারীর ÿমতায়নের বিষয়টিও গুরুত্ব পাচ্ছে বলে সুশীল সমাজের অভিমত।
বাসস ইউনিসেফ ফিচার /শামো/১৪৪০/আহো/-হাহা