চুনারুঘাটের রেমা-কালেঙ্গা শকুনের নিরাপদ আবাস্থল

397

॥ শাহ ফখরুজ্জামান ॥
হবিগঞ্জ, ৮ জুলাই, ২০১৮ (বাসস) : বাংলাদেশের শকুনের সবচেয়ে নিরাপদ এলাকা হিসেবে পরিচিত হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। এখানে রয়েছে শকুনের প্রজনন ও বিশ্রামস্থল। একশ’ শকুনের বসবাস রয়েছে এখানে। চলতি বছর প্রায় এক ডজন শকুনছানা দলটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রতি বছর এখানে শকুনের বংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা শকুনের নিরাপদ খাবারসহ সকল ব্যবস্থা করে যাচ্ছেন। সম্প্রতি রেমা গহীন অরণ্যে শকুন গবেষকরা একটি জীবিত গরু জবাই করে শকুনকে খেতে দেন। তবে গরুর মাংসে পঁচন ধরার আগ পর্যন্ত শকুন মাংস খায় না বলে গবেষকরা জানিয়েছেন।
গ্রাম গঞ্জে এক সময়ে গরু, মহিষসহ গবাদিপশুর মৃতদেহ যেখানেই ফেলা হতো দেখা যেত কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশে উড়ছে শকুনের ঝাঁক। কিভাবে তারা খবর পেত তা নিয়ে রহস্যের অন্ত নেই। দ্রুত গতিতে তারা মৃত গবাদি পশুর মাংস খেয়ে সাবাড় করে দিত। শকুন প্রকৃতি থেকে মৃত বস্তু সরানোর কাজ করে রোগব্যাধী মুক্ত পরিবেশ সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও এখন এই প্রাণী মানবসৃষ্ট কারনে বিলুপ্তের পথে। বিশেষ করে বাংলাদেশের পরিচিত বাংলা শকুন এখন বিপন্ন প্রাণী হিসেবেই পরিচিত।
এক সময় আমাদের দেশের মানুষ মনে করতেন শকুন পাখিটা অশুভ। অনেকে আবার মৃত্যুর প্রতীক হিসেবেও কল্পনা করেন এটিকে। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, শকুন যেহেতু মরা পশুর মাংস খায়, তাই প্রাণীটা সবসময় পশুর মৃত্যু কামনা করে থাকে। কারো বাড়ির ওপর দিয়ে যদি শকুন উড়ে যায়, তাহলে তা অমঙ্গলের আভাস বলেই ধরে নেয়া হয়।
বাংলাদেশের লোকালয়ে এক সময় শকুন দেখা যেতো। মৃত প্রাণীর চারপাশ ঘিরে রাখতো এই পাখিটি। প্রধানত শকুন ডানা মেলে অনুমতি দিতো মৃত প্রাণী ভক্ষণের। মুহূর্তেই নাই হয়ে যেতো মলাপ পশুর দেহ। বিশেষজ্ঞদের মতে, শকুন অশুভ তো নয়ই, হিং¯্রও নয়। চিল, ঈগল বা বাজপাখির মতো শিকারিও নয়। এটা আমাদের পরিবেশের পরম বন্ধু। মৃত পশু খেয়ে শকুন আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। শকুন কখনোই জীবিত মানুষকে আক্রমণ করে না। বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলে এখনো মাঝে মধ্যে শকুন দেখা যায়।
২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ অব ভেটেরিনারি মেডিসিন-এর গবেষক ড. লিন্ডসে ওক তার এক গবেষণায় প্রমাণ করেন, গবাদিপশুর চিকিৎসায় ব্যাথা নাশক ডাইক্লোফেনাক ও কিটোপ্রোফেন জাতীয় ওষুধ ব্যবহারের কারণে শকুন কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। ওই গবেষণায় তিনি প্রমাণ করেন, ডাইক্লোফেনাক সোডিয়াম (ডাইক্লোফেন) ওষুধ ব্যবহার করা গরু ও ছাগলের মৃতদেহ ভক্ষণ করলে কিডনি নষ্ট হয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শকুন মারা যায়। ফলে ভারত ও পাকিস্তান ২০০৬ সালে, নেপাল ২০০৯ সালে ডাইক্লোফেনাক সোডিয়াম (ডাইক্লোফেন) বন্ধ করে দেয়। পরিবর্তে মেলোক্সিম্যাসহ বিকল্প ওষুধ ব্যবহার শুরু করে। বাংলাদেশ সরকার ২০১০ সালে গবাদিপশুর চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাক সোডিয়াম উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। তবে কোথাও কোথাও এখনও ব্যবহার হয়। দেশে দু’শ’ প্রজাতির পাখি হুমকির মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শকুনও। ক্রমাগত কমছে শকুনের সংখ্যা। সত্তরের দশক থেকে এ পর্যন্ত শকুন হ্রাসের পরিমাণ ৯৮ শতাংশ। স্বাধীনতার পূর্বে বাংলাদেশে ৫০ হাজার শকুন থাকলেও বর্তমানে সবমিলিয়ে এর সংখ্যা আড়াইশ হবে। পৃথিবীতে ২৩ প্রজাতির শকুন রয়েছে। বাংলাদেশে রয়েছে ৭ প্রজাতির শকুন । এর মধ্যে ২ প্রজাতির শকুন বিলুপ্ত রয়ে গেছে। এর মধ্যে ২ প্রজাতির শকুন স্থায়ীভাবে বসবাস করে। বাকি ৩ প্রজাতির শকুন শীত মৌসুমে দেখা যায়।
চুনারুঘাটের রেমা-কালেঙ্গায় শতাধিক শকুন রয়েছে। প্রতি বছর এখান থেকে ২০/৩০টি শকুনের বাচ্চা উৎপাদন হয়। ২০১৪ সাল থেকে রেমা কালেঙ্গায় আইইউসিএন বাংলাদেশের শকুন গবেষণা প্রকল্প গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। এখানে শকুনকে নিরাপদ খাবার প্রদান করা হয় এবং গরুর কলিজার নমুনা সংগ্রহ করে বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে দেখছেন শকুনের জন্য ক্ষতিকর ড্রাগের উপস্থিতি কেমন। বিশেষজ্ঞদের মতে সঠিকভাবে শকুনের পরিচর্যা করলে বাংলাদেশের আকাশে আবারও শকুন দেখা যাবে।
আইইউসিএন বাংলাদেশের শকুন গবেষণা প্রকল্পের মুখ্য গবেষক এবিএম শারোয়ার আলম জানান, রেমা কালেঙ্গা শকুনের নিরাপদ আশ্রয় স্থল। রেমায় শতাধিক শকুন রয়েছে। প্রতি বছর এখানে শকুন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে আমরা শকুনকে মরা গরুর মাংস খাওয়ানোর আগে মাংসগুলোর মধ্যে ক্ষতিকারক ড্রাগ আছে কি না আমরা ল্যাবরেটরির মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখছি এবং গরুর কলিজার নমুনা সংগ্রহ করে বিদেশে নিয়ে ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করে দেখেছি। শকুনের জন্য ক্ষতিকর ড্রাগের উপস্থিতি কেমন, এটা জানা আমাদের চলমান প্রকল্পের একটি লক্ষ্য। সম্পূর্ন পরীক্ষার ফলাফল হাতে পেলে আমরা সরকারকে সহযোগিতা করতে পারবো শুকুন রক্ষায় কি কি প্রকল্প হাতে নেয়া যায় বাংলাদেশে। সরকারি সহযোগিতায় আমরা বাংলাদেশে শকুনের নিরাপদ আশ্রয় গড়ে তুলবো। তিনি বলেন- বাংলাদেশে প্রায় আড়াইশ শকুন রয়েছে। এর মধ্যে রেমা-কালেঙ্গায় ১শ রয়েছে। রেমা-কালেঙ্গায় কাজ করা বিদেশী শকুন বিশেষজ্ঞ মার্ক ট্যাগার বলেন- বাংলাদেশের প্রকৃতিতে শকুন নিরাপদভাবে বেড়ে উঠতে পারে। রেমা-কালেঙ্গায় শকুন নিরাপদ আশ্রয়ে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশী গবেষকদের সাথে রেমার শকুনগুলো কতটা নিরাপদ তা পর্যবেক্ষণ করতে এসেছি। এছাড়া শকুনের খাবারও নিশ্চিতের জন্য গরুর মাংস নিয়ে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হবে।
স্থানীয় বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম জানান, আমরা সব সময় রেমার শকুনগুলো দেখে রাখছি। সেগুলো থাকার জায়গা অন্য কোন প্রাণী যাতে ভাঙ্গতে না পারে তাও আমরা দেখাশুনা করছি। তিনি বলেন-এখানে এক সময় হাজার শকুন ছিল। কিন্তু এখন অনেক শকুন হারিয়ে গেছে। এ শকুনগুলো বাঁচিয়ে রাখতে গবেষকেরা যে উদ্যোগ নিয়েছেন তা নি:সন্দেহে মহৎ।
রেমা-কালেঙ্গা সহ-ব্যস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও হবিগঞ্জের সাবেক পিপি অ্যাডভোকেট আকবর হোসেন জিতু জানান, শকুন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখে। বিলুপ্তপ্রায় এই প্রাণীকে রক্ষার জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ময়না বিল এলাকায় এই পাখী যাতে নির্বিঘেœ বসবাস করতে পারে তার জন্য ২শ উঁচু গাছকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। লোকজন যাতে সেখানে গিয়ে শকুনকে বিরক্ত না করে তার জন্য ব্যবস্থাপনা কমিটিতে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবকদেরকে আলাদাভাবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার হবিগঞ্জ জেলা কমিটির সাধারন সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল জানান, রেমা-কালেঙ্গা বাংলাদেশের একটি প্রাচীন বন। এখানে উচু ও প্রাচীন গাছ রয়েছে। পাশাপাশি অনেক প্রাণীর বসবাস এই বনে। চোর এবং শিকারীদের হাত থেকে এই গাছ ও প্রাণীকে রক্ষা করতে পারলে শকুন রক্ষা পাবে।
হবিগঞ্জ সরকারী বৃন্দাবন কলেজের সহকারী অধ্যাপক ড. সুভাষ চন্দ্র দেব জানান, বিশ্বে ১৮ প্রজাতির শকুন দেখা যায়, এর মধ্যে বাংলাদেশে ৬টি প্রজাতি রয়েছে। বাংলাদেশের প্রজাতিগুলোর মধ্যে কেবল ৪টি স্থায়ী অন্য দুটি পরিযায়ী। বাংলাদেশের এন্ডেমিক প্রজাতিটি হচ্ছে বাংলা শকুন(জিপস বেঙ্গালেনসিস)। বাংলার নামযুক্ত পৃথিবীর ১০টি পাখি প্রজাতির এটি একটি।
তিনি আরও জানান, লোকচক্ষুর আড়ালে মহীরুহ বলে পরিচিত বট, পাকুড়, অশ্বত্থ, ডুমুর প্রভৃতি বিশালাকার গাছে সাধারণত শকুন বাসা বাঁধে। শকুন সকালের দিকে তেমন নড়াচড়া করতে দেখা যায় না। রোদের প্রখরতা কমলে এরা আকাশের অনেক উঁচুতে উড়ে উড়ে খাবার খোঁজে। খাবারের সন্ধান পেলে দ্রুত নিচে নেমে গোগ্রাসে দলবেঁধে খাওয়া শুরু করে। পানি পেলে এরা গোসল করে এবং পানি খায়। এটি দিবাচর পাখি হলেও কখনও কখনও সন্ধ্যার পর খাবার খেতে দেখা যায়। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দলবেঁধে বিচরণ করে। এরা শিকারি পাখি না হওয়ায় সুস্থ প্রাণীর ওপর আক্রমণ করে না। শুধু মৃত প্রাণীই খেয়ে থাকে। একদল শকুন একটি বড় মরা গরু সাবাড় করতে মাত্র ২০ মিনিট সময় নেয়। এরা ছোট ছোট টুকরো হাড় আস্ত গিলে ফেলে।