বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১ : কৃষিতে নারীর ক্ষমতায়নের উদাহরণ মর্জিনা-রশিদারা

230

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১
নারী-ক্ষমতায়ন-কৃষি
কৃষিতে নারীর ক্ষমতায়নের উদাহরণ মর্জিনা-রশিদারা
ঢাকা, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৯ (বাসস) : একটা সময় ছিলো, পুরুষেরা শুধু বাইরের কাজ করবে আর নারীরা গৃহস্থালি সামলাবে। কিন্তু সময় বদলেছে। এখন ঘরে-বাইরে বেশ দক্ষ হাতে সামাল দিচ্ছেন বাংলাদেশের নারীরা। সেটা কৃষি কিংবা চাকরি। নারী যেমন প্রশাসন চালাচ্ছেন, তেমনই ওড়াচ্ছেন উড়োজাহাজ কিংবা সামলে নিচ্ছেন অফিসের কঠিনতম ব্যবস্থাপনার কাজও।
নারীরা পিছিয়ে নেই কৃষিতেও। বর্তমান সরকারের উদ্যোগের ফলে দেশ যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে, এর পেছনে তাদেরও অবদান অনস্বীকার্য। তাদেরই একজন মর্জিনা বেগম।
মর্জিনা ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মেয়ে। বাবার মৃত্যুর পর তাদের সংসারটা যেন অকূল সাগরে পড়ে যায়। উপায়ান্তর না দেখে চোখে সর্ষেফুল দেখছিল পরিবারের সদস্যরা। সে অবস্থায় সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নেন তিনি। উপার্জনের উপায় হিসেবে বেছে নেন কৃষিকাজ।
এরই মাঝে স্থানীয় নারী কৃষকদের নিয়ে গড়ে তোলেন সিএআরডি নামের একটি সংগঠন। নারীদের স্বাবলম্বী করতে নানা প্রশিক্ষণ, কেঁচো সার তৈরি, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে কাজ করতে থাকেন।
এভাবে অল্পদিনে গোটা গ্রামের বেশ কিছু নারীকে স্বাবলম্বী করে তুললেন তিনি। নিজেও বেশ স্বচ্ছল হিসেবে এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হন।
কালীগঞ্জ উপজেলার মহেশ্বরচাঁদা গ্রামের কৃষক মৃত ওমর আলীর মেয়ে মর্জিনা বেগম জানালেন, তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এরই মধ্যে তার সংগঠন ২০১৪ সালে ও ২০১৭ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার পেয়েছে। এরপর থেকে এর সুনাম নিজের গ্রাম তো বটেই, ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের গ্রাম ছাড়িয়ে দেশজুড়ে।
মর্জিনা বলেন, প্রথমে একটু অস্বস্তি লাগতো। কিন্তু যখন আস্তে আস্তে সফলতা আসতে শুরু করে তখন আমার আর তেমনটা লাগেনি। স্থানীয় গণ্যমান্যরাও আমাকে উৎসাহ দিতে শুরু করলেন। আমি নারীকৃষকদের নিয়ে অনেক দূর যেতে চাই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিকল্পনা ও উদ্যোগে বর্তমানে নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন দুটোই হয়েছে। যা বিস্তৃত হয়েছে শহর থেকে গ্রামেও। তবে কোনো কোনো অঞ্চলে কিছুটা প্রতিকূল পরিবেশ থাকলেও পিছিয়ে নেই কেউ। এর মধ্যেই এগোতে হচ্ছে নারীদের।
সব ক্ষেত্রে হয়তো অর্জন আকাশছোঁয়া নয়। তারপরও অর্থনীতিতে নারীর অবদান উল্লেখযোগ্য। আর এভাবে শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু কমানোসহ সামাজিক নানা সূচকে নারীদের অগ্রগতিতে বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ।
পাবনার চাটমোহর উপজেলার বিল কুড়ালিয়ার রশিদা খাতুন, আছিয়া খাতুন। তারা গ্রামে ভূমিহীন অসহায় নারীদের জমি উদ্ধারে কাজ করেছেন। পাশাপাশি কৃষিতেও অবদান রেখেচেন তারা।
জানা যায়, এই নারীরা সংঘবদ্ধভাবে ১৯৯৩ সালে বেদখল হয়ে যাওয়া প্রায় ৫০০ একর জমি উদ্ধার করেন। এরপর শুরু হয় রশিদা, আছিয়া বেগমদের এগিয়ে যাওয়ার পালা।
নানা সময় কিছু প্রতিকূলতার মুখোমুখি হলেও স্থানীয়দের শিক্ষার প্রসার, বাল্যবিবাহ রোধসহ নানা উদ্যোগে শামিল হয়েছেন এই নারীরা। যাদের সম্মিলিত প্ল্যাটফর্মের নাম অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি)।
বিভিন্নভাবে এই বেসরকারি সংগঠনটি তাদের পাশে থেকেছে, সহযোগিতা করেছে। সংগঠনটির কর্মসূচি সমন্বয়কারী সানজিদা খান বলেন, জোতদারদের হয়ে পুলিশ যখন আন্দোলনকারীদের ধরতে আসলে মানববর্ম তৈরি করে রুখে দেন এ গ্রামের নারীরা। আর এখন তারা নিজেরাই নিজেদের সম্মানজনক পথ তৈরি করে নিচ্ছেন।
নারীশিক্ষা বিস্তার ও নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে বাংলাদেশ বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে একটি সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছেছে। বেড়েছে শিক্ষার হার। ২০১১ সালে বাংলাদেশে নারীশিক্ষার হার ছিল ৪৬ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০১৭ সালে ৭০ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়ায়। এখন তা আরও বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীন বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের উদ্যোগে দেশব্যাপী উদ্যোক্তা তৈরির প্রচেষ্টা হিসেবে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এসব প্রশিক্ষণ নিয়ে স্থানীয়ভাবে নিজেদের স্বাবলম্বী করে তুলছেন তরুণ-তরুণীরা। এজন্য ব্যাংক থেকেও তারা ঋণও পাচ্ছেন।
একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৬ সালে বাংলাদেশে পুরুষের তুলনায় নারীর অগ্রগতি ছিল ৬২ শতাংশের বেশি, যা বর্তমানে ৭৫ শতাংশেরও বেশি। আর তা সম্ভব হয়েছে সরকারের নানা উদ্যোগের ফলেই।
এদিকে নারীর অগ্রগতির সঙ্গে দেশে দিন দিন বেড়েছে নারীর উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে নারী উন্নয়নে বাজেটে ২৭ হাজার ১৪৮ কোটি রাখা হয়। এটি ছিল মোট বাজেটের ২৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ। আর মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)’র ৩ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে নারী উন্নয়নে বরাদ্দ আছে ১ লাখ ৬১ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। এটি মোট বাজেটের ৩১ শতাংশ প্রায়। আর জিডিপির ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ড. হোসেন জিল্লুুর রহমান বলেন, সরকারি-বেসরকারি নানা তৎপরতা বেড়েছে। তবে বাংলাদেশের নারীদের নিজস্ব উন্নয়ন স্পৃহা এই অগ্রগতির প্রধান চালিকাশক্তি।
বাংলাদেশ নারীর কর্মসংস্থানের বিষয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় এগিয়ে থাকা দেশগুলোর অন্যতম। গত এক দশকে পুরুষ ও নারীর মধ্যে মজুরি-বৈষম্যও কমিয়ে এনেছে উল্লেখযোগ্য হারে। বিশ্বব্যাংকের ‘ভয়েসেস টু চয়েসেস : বাংলাদেশেস জার্নি ইন উইমেনস ইকোনমিক এমপাওয়ারমেন্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ যদি এ ধারা অব্যাহত রাখতে পারে তবে লিঙ্গসমতা আরও বাড়বে।
একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সমন্বয়কারী জিনাত হক বলেন, বর্তমানে চাকরি, অর্থায়ন ও সম্পদের মালিকানার ক্ষেত্রে নারীদের পছন্দ, নিয়ন্ত্রণ ও সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা বেড়েছে। তবে তৃণমূল কিংবা প্রান্তিক পর্যায়ে এ সংখ্যা খুবই কম। তাই বিষয়টিকে বেশ গুরুত্ব দিতে হবে।
তিনি বলেন, নারীর অগ্রগতিতেই সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে, কর্মসংস্থান ও পুষ্টিমান বেড়েছে। শিক্ষার প্রসার এখানে একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। আর এর ফলে বেড়েছে সচেতনতা।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ)-এর সর্বশেষ বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদনে নারী-পুরুষের সমতার দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সব দেশের শীর্ষে রয়েছে।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/মাআ/আহো/১০৩০/-এইচএন