বিজয় : মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানী সৈন্যদের আত্মসমর্পণ

208

ঢাকা, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৯ (বাসস) : ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধবিরতি হলেও দুর থেকে মাঝে মধ্যেই গোলাগুলির আওয়াজ শোনা যাচ্ছিলো।
পাকিস্তানী বাহিনীর কিছু বিচ্ছিন্ন পকেট থেকে এসব গোলাগুলির আওয়াজ আসছিলো। কারণ তখনও পর্যন্ত তারা আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল না। তাদের সামরিক যোগাযোগ ব্যবস্থাও ছিল বিচ্ছিন্ন।
ডেমরায় পাকিস্তানী বাহিনী শীতলক্ষ্যা নদীর ওপারে বিভিন্ন জুট মিলে অবস্থান নেয় এবং দুপুর ১২টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত মিত্রবাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ করে। এরপর পাল্টা গুলিবর্ষণে তারা আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়। ইতোমধ্যে সেখান থেকে বহু পাক সৈন্য পালিয়ে যায়।
নিউইয়র্ক টাইমস-এ লেখা হয়, ‘সৈন্যরা ঢাকার দিকে আসার পথে হাজার হাজার মানুষ ‘জয়বাংলা’ ‘(বঙ্গবন্ধু) শেখ মুজিব’ বলে স্লোগান দিয়ে তাদের স্বাগত জানায়। মনে হচ্ছিল, ভারতীয় সেনাবাহিনীর কোন ইউনিট নয়, যেন একটি আনন্দ মিছিল ঢাকার দিকে যাচ্ছে।ভারতীয় বাহিনীর প্রথম যারা শহরে প্রবেশ করে সেটা ছিল মেজর জেনারেল জি নাগরার নেতৃত্বাধীন ১০১ কম্যুনিকেশন জোন।
এই বাহিনী অভিযান চালাতো উত্তরাঞ্চলীয় সেক্টরে। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর তারা সাভার পৌঁছে। দ্বিতীয় প্যারা ব্যাটালিয়ন ছিল মিরপুর সেতুতে। পিছু হটা পাক বাহিনী অলৌকিকভাবে সেতুটির কোন ক্ষতি করেনি। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে প্রায় সারা রাত এখানে তাদের মধ্যে গোলাগুলি হয়।
১৬ ডিসেম্বর সকালে জেনারেল নিয়াজীর কাছ থেকে যুদ্ধবিরতির খবর পাওয়ার পর গোলাগুলি বন্ধ হয়। সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল জি নাগরা ভোরে এসে পৌঁছান। ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ক্লের কাছ থেকে তিনি নিয়াজীর বার্তা পান।জেনারেল নাগরা সঙ্গে সঙ্গে দু’জন অফিসারকে যুদ্ধবিরতির পতাকা দিয়ে নিয়াজীর কাছে ব্যক্তিগত বার্তা পাঠান। এরা হলেন ক্যাপ্টেন নির্ভা কুমার ও ক্যাপ্টেন মেহতা।
বার্তায় বলা হয়, ‘আমার প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি এখানে আছি। খেলা শেষ। আমি তোমাকে ধরা দেয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছি। তোমার দেখভাল আমি করবো।’
এর কিছুক্ষণ পরেই ঢাকার কমান্ডার মেজর জেনারেল জামসেদ জেনারেল নাগরার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে মিরপুর সেতুতে আসেন। তখন সময় সকাল ১০টা ৪৫ মিনিট। দ্বিতীয় প্যারা ব্যাটালিয়ন থেকে ভারতের প্রথম বাহিনী ঢাকা প্রবেশ করে। এরপর প্রবেশ করে ৯৫ ব্রিগেডের ইউনিটগুলো।
উল্লসিত জনতা জয় বাংলা, (বঙ্গবন্ধু) শেখ মুজিব, (বঙ্গবন্ধু) শেখ মুজিব স্লোগান দিয়ে তাদের স্বাগত জানায়।
মেজর জেনারেল নাগরা নিয়াজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং চায়ের টেবিলে বেশ হাসি-তামাশা করেন। এর কয়েক ঘণ্টা পর আত্মসমর্পণের দলিল নিয়ে সেখানে আসেন মেজর জেনারেল জ্যাকব।
নিয়াজী প্রথমে আত্মসমর্পণ নয় যুদ্ধবিরতির চুক্তি করার ওপর জোর দেন। পরে তিনি আত্মসমর্পণে রাজি হন এবং বলেন, এর আয়োজন হবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে।
জ্যাকব বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম এটা হবে রেসকোর্স ময়দানে, যেখানে নয়মাস নয়দিন আগে বঙ্গবন্ধু তাঁর বিখ্যাত ৭ মার্চের (১৯৭১) ভাষণ দিয়েছিলেন।’
নিয়াজী ইতস্তত করতে থাকলে জ্যাকব তার শেষ ট্রাম্পকার্ড ব্যবহার করেন। তিনি বলেন, ‘হয় তুমি আমাদের শর্ত পুরোপুরি মেনে নাও, নয়তো আমরা বিষয়টি মুক্তিবাহিনীর কাছে ছেড়ে দিবো।’
এতে কাজ হলো। যুদ্ধবিরতির সময়সীমা পার হওয়ার ১০ মিনিট আগে গম্ভীর মুখে নিয়াজী কোন কাটছাট ছাড়াই আত্মসমর্পণের সব শর্ত মানতে রাজি হন।
বিকেল ৫টায় দলিল স্বাক্ষরের পর ঢাকা রেসকোর্স উল্লাসে ফেটে পড়ে এবং ঢাকা একটি স্বাধীন দেশের একটি স্বাধীন রাজধানীতে পরিণত হয়।
ভারতের তরফ থেকে এই আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ড জিওসি-ইন-কমান্ড লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা।
এর আগে স্থানীয় পাকিস্তানী সৈন্য ও ভারতীয় সৈন্যদের দেয়া এক গার্ড অব অনার পরিদর্শন করেন লে. জেনারেল অরোরা।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে শেষ হয় সকাল থেকে শুরু হওয়া চরম হিসাব-নিকাশের আলোচনার।
অরোরার কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে জেনারেল নিয়াজী তার পিস্তল বের করেন। পিস্তল থেকে বুলেট সরান এবং অরোরার কাছে পিস্তলটি হস্তান্তর করেন।
সেখানে উপস্থিত এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এই পিস্তল হস্তান্তরের মধ্যদিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে হস্তান্তর করা হলো।’
এরপর পাকিস্তান সেনা সদর দফতর থেকে স্থানীয় সেনা ছাউনিগুলোকে ব্যক্তিগতভাবে আত্মসমর্পণের বার্তা পাঠানো হয়। সে অনুযায়ী পাকিস্তানের বিভিন্ন কমান্ডার তাদের ভারতীয় কমান্ডারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আত্মসমর্পণের ব্যবস্থা করেন। সব মিলিয়ে ৯০ হাজারের বেশি যুদ্ধাপরাধী আত্মসমর্পণ করে।
এসময় স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতা ও বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনও পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী।
সেখানে তাঁকে বাইরের বিশ্বের সব ধরনের খবরাখবর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল।
এদিকে নয়াদিল্লীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় বক্তৃতাকালে ‘একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন রাজধানী’ হিসেবে ঢাকার নাম উল্লেখ করেন।