বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২ : ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধ হোক

121

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২
ঝুঁকিপূণ-শিশুশ্রম
ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধ হোক
ঢাকা, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৯ (বাসস) : রাজধানীর কমলাপুরের একটি গ্যারেজে কাজ করে সাগর। বয়স আনুমানিক ১২ বছর। প্রথমে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ শিখতে হয়েছে তাকে। এখন মালিক তাকে দিনে ৮০ টাকা আর দুপুরে খাবার দেয়। কোনো ছুটি নেই। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যান্ত কাজ করতে হয়। কষ্ট হলেও সে এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ তার ঠেলাগাড়িচালক বাবার পক্ষে ৬ জনের পরিবারকে ভরণ-পোষণ করা সম্ভব নয়। তাই পরিবারের অভাব কিছুটা লাঘব করার জন্য বাবাকে সাহায্য করছে সে।
বাংলাদেশে শিশু শ্রমের প্রধান কারণ হচ্ছে দরিদ্র্য এবং সচেতনতার অভাব। দরিদ্র্য পরিবারের পক্ষে ভরণ পোষণ মিটিয়ে সন্তানের লেখাপড়ার খরচ যোগান দেয়া অনেক সময় সম্ভব হয় না। প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে শিশুদের পর্যাপ্ত সরকারি সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও অনেক বাবা-মা অসচেতনতার কারণে তার সন্তানকে স্কুলে না পাঠিয়ে অর্থ লাভের আশায় শিশুশ্রমে নিয়োজিত করেন। যা অত্যন্ত অমানবিক, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং শিশুর শিক্ষার পথে সবচেয়ে বড় বাধা।
আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫ শতাংশ শিশু। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ অনুযায়ী, দেশে ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী শ্রমজীবী শিশুর সংখ্যা প্রায় ৭৪ লাখ। এদের মধ্যে একটি অংশ ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। জরিপে দেখা গেছে দরিদ্র বা বস্তি এলাকার শিশুদের ৬৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিস্কাশন সুবিধা, ৫৯ শতাংশ তথ্য লাভের অধিকার, ৪১ শতাংশ বাসস্থান এবং ৩৫ শতাংশ বিশুদ্ধ খাদ্য থেকে বঞ্চিত হয়। ‘বাংলাদেশে শিশুশ্রমের অবস্থান’ শীর্ষক এক সমীক্ষায় শিশুশ্রমের কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে- দারিদ্র্য, পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি না থাকা, বাবা-মা পরিতাজ্য, অসেচতনতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অভিবাসন ইত্যাদি।
জাতিসংঘ ১৯৫৯ সালে শিশু অধিকার সনদ ঘোষণা করে। বাংলাদেশ এই সনদে স্বাক্ষরকারী একটি দেশ। বাংলাদেশ শিশু আইন অনুযায়ী ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সবাইকে শিশু হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। শিশু অধিকার সনদে বলা হয়েছে, শিশুদের ক্ষেত্রে কোন ধরণের বৈষম্য করা যাবে না। সমাজকল্যাণমূলক এবং আইনের ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য হবে শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থ। রাষ্ট্রসমূহ শিশুদের পরিচর্যা এবং সরকার শিশুদের সেবা ও সুবিধাদি প্রদান করবে। শিশুদের মৌলিক অধিকার যেমন- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে হবে। শিশুর পরিচয় ও জাতীয়তা অর্জন এবং প্রতিপালিত হওয়ার অধিকার থাকবে। শিশুকে অপহরণ করা, অবৈধভাবে দেশত্যাগ করানো অথবা পাচার করা যাবে না। শিশুর বিকাশের পরিবেশ এবং অধিকার দিতে হবে। পিতা-মাতার পরিচয়বিহীন শিশুকে রাষ্ট্র লালন করবে। শিশু নির্যাতন ও জবরদস্তীমূলক কোনো কাজ করা যাবে না। যৌনাচারে ব্যবহার করা যাবে না। পঙ্গু শিশুকে পরিপূর্ণ সামাজিক, সুন্দর পরিবেশে জীবন যাপনের মর্যাদা দিতে হবে। শিশুশ্রম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। শিশুদের আর্থিক সুবিধা দিতে হবে। শিশুদের অপরাধ জগতে প্রবেশের পথ রুদ্ধ করতে হবে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও’র) একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের শিশুরা অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ, অ্যালুমিনিয়াম, আগরবাতি, বেলুন, ব্যাটারি, রি-রোলিং, আসবাবপত্র কারখানা, মোটর গ্যারেজ, গ্যাস বার্নার মেরামত, বই বাঁধাই, বৈদ্যুতিক কাজ, চামড়া কারখানা, গাড়ি ও ফার্নিচারে রং করা, বাতি তৈরি ও লেদ মেশিনে লোহা কাটার মত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করছে। তারা শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আক্রান্ত হচ্ছে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ শিশুশ্রম নিরসনে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশে ইউনিসেফ, আইএলও এবং বিজিএমইএ পোশাক শিল্পে শিশুশ্রম নিরোধে ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা সনদ স্বাক্ষর করেছে। যেখানে গার্মেন্টস শিল্পে শিশুশ্রম বন্ধ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকারের কঠোর নজরদারীতে গার্মেন্টস সেক্টরে শিশুশ্রম বন্ধ হয়েছে। এছাড়া দরিদ্র এলাকা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকার শিশুদের শিক্ষা, চিকিৎসার জন্য ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
আগামী ২০২১ সালের মধ্যে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে চলেছি। তাই শিশুশ্রম প্রতিরোধে ১৮ বছর বয়সের নীচে কোন শিশু যেন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে না পারে তার জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন অভিভাবকদের সচেতনতা। কারণ আমাদের দারিদ্রের হার অনেক কমে গেছে। প্রাথমিক স্তর থেকে শিশুদের ঝরে পড়া রোধ করতে হবে। শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। যেসব বাসা এবং কারখানায় শিশু শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত, তাদের মালিককে শিশুর প্রতি যতœশীল হতে হবে। তাদের কম কষ্টের এবং ঝুঁকিহীন কাজ করার পাশাপাশি শিক্ষার সুযোগ এবং স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শিশুশ্রম পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে বাসা বা কর্মক্ষেত্রে তারা যেন নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার না হয়, ঝুঁকিমুক্ত কাজ করতে পারে সেদিকে সবাইকে সচেতন হতে হবে। আমরা সবাই মিলে যদি আমাদের শিশুদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করি, শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে পারি তাহলে আমাদের উন্নত দেশ গড়ার স্বপ্ন সফল হবে। ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের অভিশাপ থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হবে ইনশাল্লাহ।
বাসস ইউনিসেফ ফিচার/হাবিবুর/আহো/১৮৫৫/-কেজিএ